Reptiles Farm Ltd.

Reptiles Farm Ltd.
crocodilefarmer@gmail.com

Wednesday, 30 March 2011

আমরাও পারি

শীতের সকালও যে সরগরম হতে পারে, প্রমাণ মিলল এ মাসের ১৭ ও ১৮ তারিখে। পৌষের শুরুর দিকের সেই দুটি দিনে সাভারের ব্র্যাক টার্কে বসেছিল মেধাবিকাশ শিক্ষা সমাবেশ ২০১০-এর আসর। প্রায় ৬০০ মেধাবী তরুণ ছিলেন সেই আসরের প্রাণ। ব্র্যাকের আর্থিক সহায়তায় যাঁরা কিনা এখন শিক্ষার সিঁড়ি পেরোচ্ছেন বিভিন্ন পর্যায়ে। সমাবেশটির আয়োজন করেছিল ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির মেধাবিকাশ উদ্যোগ। আর বলা বাহুল্য, সেই আয়োজনে তরুণদের সরব উপস্থিতির দাপটেই শীতের হিম আবহাওয়া একদম পাত্তা পায়নি।
সমাবেশের প্রথম দিন, ১৭ তারিখে, অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল সাড়ে নয়টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বিশেষ অতিথিদের মধ্যে ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব নজরুল ইসলাম খান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির পরিচালক শফিকুল ইসলাম, সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র অ্যাডভাইজার মনজুর আহমদ।
শিক্ষার মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিতদের আলোকিত করতে ব্র্যাক ব্যাপক ও বিস্তৃত শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। দুই দশক ধরে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রচার, প্রসার ও সহযোগিতার ফলে দরিদ্র পরিবারগুলো থেকেও প্রতিবছর বেশ কিছু মেধাবী ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে আসছেন। ব্র্যাক ‘মেধাবিকাশ কার্যক্রমে’র মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। ২০০৫ থেকে এ পর্যন্ত ১১৮৭ জন শিক্ষার্থীকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ব্র্যাক। এদের মধ্যে আবার ৩৬ শতাংশই ব্র্যাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। আর এখন এই ১১৮৭ জনের মধ্যে স্নাতক পর্যায়েই আছেন ২৩০ জন। এ ছাড়া মেধাবিকাশ কর্মসূচির সহায়তায় দেশের বাইরেও পড়াশোনা করছেন বেশ কজন শিক্ষার্থী।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর বক্তৃতার পুরো সময়টুকু মজিয়ে রাখেন ছাত্রছাত্রীদের। বলেন, ‘মানুষ আলোকিত হয় না; আলোকিত হওয়ার চেষ্টা করে মাত্র। আর এই চেষ্টাটাই আলোকিত হওয়া। তোমরাও নিশ্চয়ই এই চেষ্টাটাই করবে, আলোকিত হবে, দেশকে দেখাবে আলোর পথ।’ মোহাম্মদ কায়কোবাদও আশাবাদী নতুন প্রজন্মকে নিয়ে। তবে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি নিয়েও নিজের হতাশার কথা বলেন তিনি। নজরুল ইসলাম খান বাতলে দেন শিক্ষার মাধ্যমে সহজ ও উপযোগী পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা। প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘ব্র্যাকের এই কর্মসূচিকে আরও সমৃদ্ধ এবং ব্যাপক আকারে নিয়ে যেতে আমরা বদ্ধপরিকর। বিশেষ করে এই কর্মসূচিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ সামনে আরও বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে উন্নীত করা হবে।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরে মেধাবিকাশের প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থী মিলে তৈরি করেন বাংলাদেশের একটি মানচিত্র। ছাদ থেকে সেই দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করেন আলোকচিত্রীরা। ফটোসেশন শেষ হলে দুপুর বারোটার দিকে শুরু হয় বিতর্ক ও প্যানেল আলোচনা।
অংশগ্রহণকারী সবাই ছিলেন মেধাবিকাশ কর্মসূচির শিক্ষার্থীরাই। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় উপস্থিত ছিলেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, নটরডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা। প্যানেল আলোচনায় ছিলেন টিকিউআই-সেপ-এর প্রকল্প পরিচালক ও যুগ্ম সচিব নজরুল ইসলাম ও মনজুর আহমদ।
সমাবেশে অংশ নেওয়া তরুণেরা এসেছেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে। তাঁদের কেউ কেউ পড়ছেন মাধ্যমিক পর্যায়ে, কেউবা উচ্চমাধ্যমিকে আর কেউ কেউ স্নাতক পর্যায়ে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজশাহীর তাসলিমা খাতুন, পঞ্চগড়ের রুমি বেগম, গাইবান্ধার মোসলেমা আক্তার ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাপিয়ে জাহান। ছেলেদের দলটাই ভারী ছিল, ভারী সেই দলের ময়মনসিংহের আবদুল্লাহ আল নোমান, কুড়িগ্রামের মো. আরিফুজ্জামান, রংপুরের পল্লব গোস্বামী, রাজশাহীর আহমেদ, ঢাকার আবদুস সালাম, দেবাশীষ বিশ্বাসদের সঙ্গে কথা হলো। তাঁদের প্রত্যেকের মুখেই একই প্রত্যয়, ‘ব্র্যাকের কাছ থেকে আমরা যে সহায়তা পেয়েছি, তা কাজে লাগাতে চাই। এতগুলো বড় বড় মানুষের সাহচর্য পেলাম—এটাও একটা বড় প্রাপ্তি। আমরাও বড় হয়ে দেশের জন্য, মানুষের জন্য ভালো কিছু করব।’
দুপুরের বিরতি শেষে শুরু হয় মুক্ত আলোচনা। আলোচক ছিলেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। মানবিক গুণাবলি বিকাশে সাহিত্য নিয়ে কথা বলেন তিনি। সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে, ধীরে ধীরে জমতে শুরু করেছে শীতের আঁধার। ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সূচনা বক্তব্য দেন ব্র্যাকের পেইসের মহাব্যবস্থাপক জয়া সেন গুপ্তা। আর এর পরই মেধাবিকাশের শিক্ষার্থীদের আরেক প্রস্থ মেধার পরিচয়। কুইজ প্রতিযোগিতা দিয়ে শুরু। তারপর নাচ-গান। এতে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মেধাবিকাশের বেশ কজন শিক্ষার্থী। আর ১৭ তারিখের আয়োজনের শেষ হয় জনপ্রিয় ব্যান্ডদল শিরোনামহীনের গান দিয়ে।
দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই ছিল মুক্ত আলোচনা। মুখ্য আলোচক ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও তারুণ্য নিয়ে আলোচনা করেন। ব্র্যাক নেটের সভাপতি আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী ছিলেন এই আলোচনা অনুষ্ঠানের সভাপতি। এরপর চারজন সফল মানুষ তাঁদের চলার পথের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আলোচনা করেন। এঁরা হলেন পারসোনার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কানিজ আলমাস খান, বিডি জবসের সিইও একে এম ফাহিম মাশরুর, রেপটাইল ফার্ম লিমিটেডের পরিচালক মুশতাক আহমেদ ও জাতীয় দলের শ্যুটার সাবরিনা সুলতানা। ব্র্যাক প্রশিক্ষণ বিভাগের সাব্বির আহমেদ চৌধুরী এ পর্বের সভাপতি ছিলেন। এ পর্বটি পরিচালনা করেন প্রথম আলোর উপ-ফিচার সম্পাদক জাহীদ রেজা নূর।
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লেখক অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সিরাজুল ইসলাম। সভাপতি ছিলেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ড. মাহবুব হোসেন। অধ্যাপক হায়াৎ মামুদের একটি কথা দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। তিনি এই শিক্ষার্থীদের জানান, শিক্ষার্থীরা তাঁকে ভয় পায় না, তিনি কাউকে ভয় দেখান না। ভালোবাসা থেকে সবকিছু জন্মায়। ভয় থেকে ভালো কিছু হয় না। তিনি বলেন, ‘আমরা সম্মিলিতভাবেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি, এ কথাগুলো বিশ্বাস থেকে বলা দরকার, অন্তর থেকে বলা দরকার।’
শিক্ষার্থীরা দুটি দিন নিজেদের তৈরি করে নেওয়ার মতো অনেক রসদ পেয়ে গেলেন। এ রকম মিলনমেলা মাঝে মাঝেই হওয়া দরকার।

No comments: