Reptiles Farm Ltd.

Reptiles Farm Ltd.
crocodilefarmer@gmail.com

Wednesday, 14 August 2019

প্রকৃতির কাছে - পাহাড়ে ও জঙ্গলে

পামি আর শিপু ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিয়ে মনে হোল মরার আগে কালিম্পং আর ডুয়ার্স না দেখে মরলে, জীবনটাই বৃথা থেকে যাবে। পামির দক্ষিণ দিনাজপুর প্রবাসী ভাগিনা তান আমাদের টুর গাইড। যোগাযোগ করলাম- সিকিম যাবো। তান জিজ্ঞেস করলো কবে যাবো- দের মাস সময় হাতে রেখে তারিখ ঠিক করলাম। আমি এর আগে দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, কালিম্পং বা গ্যাংটকে যাই নাই। তান জিজ্ঞেস করলো আমি অফবিট টুর করবো কিনা। অর্থাৎ মেইন শহরে হোটেলে না থেকে শহরের কাছে কোন কটেজে থাকা। 
লিপা আমাদের বিয়ের আগেই দার্জিলিং, শিলিগুড়ি আর নেপাল ঘুরে এসেছে। আমাকে শহরের চাইতে পাহাড়-বন-জঙ্গল বেশী টানে। পামি আর তান এর সাথে কোথা বলে বুঝেছি, তান এই এলাকা গুলো খুব ভাল ভাবে চিনে। গত প্রায় আট বছর ধরে তার নিত্য সহচর বাপ্পাকে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে।
শহরের ভ্রমণের সাথে অফবিট ভ্রমণের মুল পার্থক্য শহরে হোটেলে থাকা যায়। সধারনত সব ধরনের সেবাই হোটেলে পাওয়া যায়। অফবিট এর ক্ষেত্রে, থাকা খাওয়া খুব সাধারণ মানের। কিন্তু অবশ্যই পরিচ্ছন্ন। রুম সার্ভিস নাই, খাবার সময়টা নির্দিষ্ট। রুমে টেলিভিশন বা ফ্যান নাই। যেহেতু জঙ্গলের ভিতরে প্রকৃতির সাথে থাকা, তাই বাথরুমে কেঁচো দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। 
তান এর সাথে আলাপ করে আমি তাকে বলেছিলাম আমাকে ভালো গাড়ি দিতে হবে ভালো ড্রাইভার সহ এবং যায়গা গুলোতে বুকিং করে দিতে হবে।       
প্রথমে সে একটা রুট লিখে পাঠাল, সঙ্গে কিছু ছবি। আমি সেটা আমাদের এক্স ক্যাডেটদের গ্রুপে শেয়ার করেছি  কে কে যাবে? কারণ গ্রুপ সাইজ আবার সর্বচ্চ আট। আমার প্ল্যান ছিল আমি আর লিপা- সঙ্গে যদি কেউ যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন ইচ্ছা প্রকাশ করলো। এর মধ্যে বন্ধু আনিস ফোন করলো সে যাবে, কিন্তু যদি সিকিমে যাওয়ার অনুমতি না পাওয়া যায়, সে আমার সাথে যাবে বাকি অংশ গুলোতে। 
ভিসা অ্যাপলাই করার পর পর আমার স্ত্রী লিপা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। এদিকে প্রচুর বৃষ্টি। একদিন দেখি সিকিমের রাস্তা বিচ্ছিন্ন। তারপর দেখি রং টং চা বাগানে যাওয়ার রাস্তা বিচ্ছিন্ন। রং টং চা বাগানের কটেজটা আমাদের এই ভ্রমণের  সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য। আমি নিশ্চিত ছিলাম ১৫ দিন ঐ রাস্তা বিচ্ছিন্ন থাকবে না। তা ছাড়া ১৫ দিন লাগাতার বৃষ্টি হয় না। এর মধ্যে করনেশন ব্রিজের কাছে একটা জিপ নিছে পড়ে গেছে। তিন জন তখন বলে বসলো, আমরা ওখানে যাওয়ার পড় আটকে যাওয়ার সম্ভবনা আছে, তাই আপাতত যেতে চাই না। 
আনিসের একটা বাধ্যবাদকটা ছিল, ২৮ তারিখে তাকে বর্ডার পার হতে হবে। সুতরাং একটা জটিল পরিস্থিতি। আনিসের ইচ্ছা ছিল অফবিট টুরের সাথে একটু দার্জিলিং শিলিগুড়িও ঘুরে আসা। তান আমাদের জন্য যেই পরিকল্পনা করেছে, তাতে সে প্রধান প্রধান শহরকে পাশ কাটিয়ে গন্তব্য ঠিক করেছে।    
আমি তানকে যানিয়ে দিলাম, আমরা পাঁচ জনই আসবো। আমি সিকিম যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিলাম, আনিস বাদ দিল দার্জিলিং-শিলিগুড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা। আমাদের গন্তব্য ঠিক হোল জলপাইগুরি, কালিম্পং ও দার্জিলিং।


নীলসাগর এক্সপ্রেস  
ছোটবেলার বন্ধু ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তৌহিদ এর পোস্টিং সৈয়দপুরে হওয়ার পর থেকেই ইচ্ছা ছিল সৈয়দপুরে যাবো। উত্তরবঙ্গের জেলা গুলোতে আমার যাওয়া হয়েছে খুব কম। দার্জিলিং আর সিকিম এর গল্প শুনলেই মাথায় উকি ঝুঁকি মারে, যাওয়ার ইচ্ছাটা। সৈয়দপুরের কাছেই তিনটা বর্ডার। আমি ম্যাপ দেখে ঠিক করেছি আমরা চেংড়াবান্ধা দিয়ে ইন্ডিয়ায় ঢুকব। আনিস এর প্রস্তাব ছিল আমরা ট্রেনে করে সৈয়দপুর যাবো, সবাই আড্ডা দিতে দিতে। সেই ভাবে যাওয়াটা ট্রেনে প্রথমেই ঠিক করে ফেলেছি, তবে ট্রেন জার্নি অনেক লম্বা। তাই ঠিক করলাম আমরা যাওয়ার সময় ট্রেন এ যাবো, আর তিন তারিখে ফেরার সময় প্লেনে ফিরবো। ফেইসবুকে আমাদের মুশকিল আসান গ্রুপে একটা পোস্ট দিলাম সৈয়দপুরে কেউ আছে নাকি। কিছুক্ষণ পরই রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের ছোটভাই মেজর ফাহাদ যোগাযোগ করলো।
মেজর ফাহাদকে বললাম আমাকে একটা মাইক্রোবাস ঠিক করে দেওয়ার জন্য, সৈয়দপুর থেকে বুরিমারি যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে গাড়ির ছবি পাঠালো, ভারা জানলো। সুতরাং গাড়িও ঠিক করে ফেললাম। ১০৯ কিলোমিটার দূরত্ব, আমার জন্য একেবারেই নতুন রাস্তা। ঢাকা থেকে সৈয়দপুর ট্রেন ৩৪০ কিলোমিটার যাত্রাও আমার জন্য নতুন।  
আনিস আমার ছোটবেলার আরেক বন্ধু। কিন্তু ও সামরিক বাহিনীতে কাজ করতো, তাই আমাদের এক সাথে ঘোরা হয় নাই। অনেক দিন থেকেই ওকে বলে আসছি, নেক্সট টাইম একসাথে যাবো। অনেক দিন থেকেই সিকিম যাওয়ার প্ল্যান। এর মাঝে দেখলাম পরিচিত অনেকেই ঘুরে এসেছে। আমি যখন মনে মনে ঠিক করলাম আমি যাবো, আমি আমাদের ট্র্যাভেল গ্রুপে পোস্ট দিয়েছি ৩০এ জুন। অনেকের সাথে আনিসও ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। কিন্তু ওর সামরিক বাহিনীর ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে সিকিম যাওয়ার অনুমতি নিতে সময় লাগবে। এদিকে আবার যেই তারিখের জন্য আনিস অনুমতি নিবে, সেই তারিখে ভ্রমণ করতেই হবে। সেই কারণে এবার কাটছাট করে সিকিম বাদ দিলাম। 
২৭ তারিখে আমি আর লিপা সবার আগে প্রায় সারে সাতটায় গিয়ে কমলাপুর পৌছালাম। ইনফরমেশন বোর্ডে নীলসাগর ট্রেন এর পাশে কিছু লেখা নাই কখন ছাড়বে। এর কিছুক্ষণ পড় আনিস আর তার বৌ বন্যা এলো। তারপর পর  ফারুক। ফারুক সিলেট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। ঘোরাঘুরি আরে ছবি তোলা তার নেশা। ৮:১৫ তে ট্রেন ছাড়ার কথা, কিন্তু কোথাও কেউ নাই স্টেশনে যাকে জিজ্ঞেস করবো আপডেট। যাকেই জিজ্ঞেস করি -উত্তর একটাই- আমি জানি না। আনিস এস.এম.এস করে জানালো ট্রেন তখনো যমুনা ব্রিজের অপর পারে। প্ল্যান ছিল, বিকালের দিকে সৈয়দ পুর পৌঁছালে, তৌহিদের সাথে সন্ধ্যাটা কাটানো যাবে। প্রথমেই একটা হোঁচট খেলাম। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বেড় করে কমলাপুরের ছবি তোলা শুরু করলাম।
কমলাপুর স্টেশন 
সমস্ত ব্যাগ নিয়ে আবার গেলাম দোতালায় রেস্টুরেন্টে। সময় কাটানোর অন্যতম পন্থা কিছু খাওয়া- আমরাও তাই করলাম। এর ফাকে আমরা আমাদের টিকেটের টাকার হিসেব করে ফেললাম, ঢাকা থেকে বুরিমারি আবার ফিরে আসা- জন প্রতি ৫,৩২৪ টাকা (১০২৪, ৭০০, ৯০০, ২৭০০)। আয়েস করে নাস্তা, চা খেয়ে, দুপুরের খাবার প্যাকেট করে নিয়ে নিচে নামলাম। ট্রেন আসে ট্রেনা যায়, কিন্তু আমাদের নীলসাগর এক্সপ্রেসে আর আসে না। সারা স্টেশন ঘুরে দায়িত্ববান কাউকে পেলাম না যাকে জিজ্ঞেস করবো ট্রেন কোথায়। এমনকি একটা তথ্যকেন্দ্র আছে, সেখানে কোন মানুষ নাই। শেষ পর্যন্ত পাঁচ ঘণ্টা পরে দুপুর একটায় নীলসাগর ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করলো।  
ট্রেনে উঠে দেখি আমাদের একটা টিকেট এক কেবিনে, বাকি চারটা পাশের কেবিনে। কেবিনগুলোতে আট জনের বসার কথা। আমরা টিকেট বদল করে, সবাই এক কেবিনে বসলাম। ট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে আমাদের কেবিনে আরেকজন প্যাসেঞ্জার এলো। কিন্তু আট জনের কেবিনে ছয় জন বেশ আরামেই যাত্রা শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই এলো বাদশা ভাই, আমাদের কেবিনের অ্যাটেন্ডেন্ট। উনি আসার সাথে সাথেই ফারুক তার একটা ইন্টার্ভিউ নিয়ে বাদশা ভাইকে জানিয়ে দিলো- বাদশা ভাই ক্লাস থ্রিতে অংকে ফেল করেছে। আমরা যা বুঝলাম উনি অনেক বছর ধরে এই একই কাজ করছেন তবে সেটা ৪০ না ৬০ বছর বুঝতে পারলাম না।
আমাদের চা নিয়ে এল। ভ্রমনের শুরুতেই বোঝা হয়ে গেলো- পাঁচ জন মানুষ তিন রকমের চা। বন্যা আর ফারুকের জন্য দুধ চা-চিনি সহ, আমার আর লিপার জন্য রং চা- চিনি সহ, আনিসের জন্য চিনি ছাড়া রং চা। চা খেতে খেতেই মনে হোল আমরা যেই খাবার প্যাকেট করে এনেছি, সেটা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। সুতরাং প্রথমেই খাবার পর্ব শেষ করে, আমি আর ফারুক ব্যাংকের উপড়ে উঠে ঘুম।
২০ টাকা দিয়ে বালিশ ভাড়া করেছি, আর দুলুনি ফ্রি- সুতরাং দুপুরের ঘুমটা জম্পেশ হোল। লিপা যখন আমাকে ডাকলো, তখন ট্রেন যমুনা ব্রিজের উপর কাছা কাছি। ক্যামেরা বের করে চেষ্টা করলাম কিছু ছবি তুলতে। সন্ধ্যাটা কেটে গেলো একবার এই দরজা  আরেকবার ওই দরজা দিয়ে দেখতে দেখতে। সন্ধ্যার পরপর আমরা নাটোর পৌঁছে গেলাম। সময় হিসেব করে বুঝলাম, ট্রেন অনেক জোরে যাচ্ছে, আমাদের সম্ভাব্য পৌঁছানোর সময় রাত ১১/১২ হবে। বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন থামে, আমরাও বাদশা ভাইকে দিয়ে কিছু না কিছু আনাই। এভাবেই পেয়ারা এল।
সবাই তখন কিছুক্ষণ পর পর ফোনের ম্যাপ এ দেখছি আমরা তখন কোথায় আর সৈয়দপুর কোথায়। আমি ঢাকা চট্টগ্রাম অনেকবার ভ্রমণ করেছি। এমনকি ঢাকা-রাজশাহী, বা ঢাকা-সিলেটও অনেকবার ভ্রমণ করেছি। কিন্তু এই দিকের স্টেশন গুলোর নাম আমার জন্য একেবারে নতুন।  
সন্ধ্যার পর থেকে তৌহিদ কয়েকবার ফোন করলো, আর ওর ফোন মানেই গালি। কেন আমরা ট্রেনে আসছি, কেন আমরা প্লেনে এলাম না- ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার আর তৌহিদের বন্ধুত্বের রসায়নটা একেবারে ভিন্ন। বেচারা সারা সন্ধ্যা অপেক্ষায় আছে। সুতরাং গালি দেওয়ার নৈতিক অধিকার সে অর্জন করেছে। 
আমাদের পেয়ারাগুলো লিপা কেটে কেটে সবাইকে দিচ্ছিলো। শেষ পেয়ারা কাটার সময় লিপার হাত কেটে গেল। আমাদের সাথে ব্যান্ডএইড থাকার কথা- কিন্তু ওই সময়ে তা খুঁজে পাওয়া গেলো না। ট্রেনে খোজ করে কোন ফার্স্ট এইড পাওয়া গেল না। তখন অবশ্য আমরা সৈয়দপুর থেকে খুব বেশী দুরে না। আফটার-শেভ লোশন দিয়ে পরিষ্কার করে, টিস্যু পেপার দিয়ে ব্যান্ডেজ করে, বিরিয়ানির প্যাকেটের রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো হোল রক্তপাত।
আমি ফাহাদকে জানালাম, আমরা পৌঁছানোর পর একটু ফার্স্ট এইড লাগবে। আনুমানিক দশটার সময় আমরা সৈয়দপুর স্টেশনে পৌঁছালাম।

সৈয়দপুরে বন্ধুর সাথে   
ট্রেন যখন সৈয়দপুরের কাছা কাছি তখন ফাহাদ ফোনে জানালো তার বাসায় চা খেতে যেতে হবে, সেটা যত রাতই হোক। আমিও তাকে বলেছিলাম চেষ্টা করবো। ট্রেন থেকে যখন আমরা নামলাম তখন প্রায় রাত দশটা। তৌহিদের পাঠানো গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। স্টেশন থেকে নেমে শহরের মধ্যে দিয়ে গেলাম ক্যান্টনমেন্টে। সৈয়দপুর শহরে আনিস আর বন্যার অন্যে পুরনো স্মৃতি। তাই যেতে যেতে শুনছিলাম কোথায় কাবাব খেতে যেত, কোথায় কেজি হিসাবে কাপড় কিনত। 
স্টেশন অফিসারস মেসে আমাদের জন্য তিনটা রুম ঠিক করা ছিল। গাড়ি থেকে নেমে আমার প্রথমেই মনে হোল, রুমে কি এয়ার ফ্রেশ্নার বা এয়ারোসোল দেয়া হয়েছে? আনিস আর লিপার এটাতে ভয়াবহ অ্যালার্জি আছে। কেউ ঢুকার আগে আমি রুমে ঢুকেই বুঝলাম সর্বনাশ। কর্তব্যরত স্টাফরা অবাক হয়ে গিয়েছে কি হোল। তাদেরক বললাম, তাদের কোন সমস্যা না। আমরা তখন কিছুক্ষণ দরজা জানলা খুলে রেখে, রুমের ফ্যান চালিয়ে চেষ্টা করলাম লিপা আর আনিসের বাস যোগ্য করার জন্য। 
অফিসারস মেসের এই রুমগুলো ভি আই পি দের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। রুমের ভিতরের ইন্টেরিওর খুবই সুন্দর। যেখানে যা থাকা দরকার, সেখানে ঠিক সেটাই আছে। রুমের পেইন্টিং চোখে পড়ার মতো। আমরা রুমে ঢুকার সাথে সাথেই একজন মেডিক্যাল আটেন্ডেন্ট তার ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে চলে এসেছে। লিপার হাতে ড্রেসিং করার সময় তৌহিদ আর তার বৌ পাপড়ি এসেছে। তৌহিদ বরাবরের মতো গাড়ি থেকে নেমেই আমাকে ডাকা ডাকি শুরু করেছে। কিন্তু রুমে ঢুকে ড্রেসিং করা দেখে তো দুই জনে ভয় পেয়ে গেলো, তারপর সব শুনে আশ্বস্ত হোল, তেমন কিছু না।  
মেডিক্যাল আটেন্ডেন্ট চলে যাওয়ার পড় তৌহিদ আমাকে পাঁচ দফা গালি দিল, আমার কোন কোন সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। যদিও একটাও আমার মনে নাই। এরপর আমরা সবাই মিলে মেস থেকে হেঁটে আড্ডা দিতে দিতে তৌহিদের বাংলোতে গেলাম। সেখানে সে তৈরি ছিল আমরা বিকালে পৌছাব। তার স্পেশাল করমচার জুস দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করলো। করমচার উপর তৌহিদ একটা ছোটখাটো বক্তিতা দিয়ে দিল। এরপরই আমাদের ভোজন পর্ব। খুবই মজার মজার খাবার। শুটকি মাছের একটা দর্মারই ছিল- যা ছিল অসাধারণ।  
এরপর এলো চা, বিশেষ চা। তৌহিদ এর গ্রিন টি। কেউ কেউ অবশ্য নিল লিকার চা, আবার কেউ কেউ নিল দুধ চা। চা পর্ব শেষ করে আমরা ওর বাংলোর দোতালায় গেলাম আড্ডা দিতে। আড্ডা পর্ব আর শেষ হয় না। পরদিন সকালে পাপড়ি ফেরত যাবে ঢাকায় আর আমাদের আছে লম্বা রাস্তা। তাই অনেক হাসা হাসি আর আড্ডা শেষ হোল রাত একটায়। ঠিক হোল পরদিন সকাল আটটায় আমরা তৌহিদের বাংলোতে একসাথে নাস্তা করবো। বাংলো থেকে আবার ফিরে এলাম মেসে।  
আনিস যেহেতু এখানে এক সময় কাজ করেছে, তাই ওর চোখে ক্যান্টনমেন্টের পরিবর্তন  গুলো ধরা পরছিল। এগুলোর গল্প শুনতে শুনতেই রুমে এলাম। ঘুমাতে একটুও সময় লাগলো না। তবে ঘুম ভেঙ্গে গেল খুব সকালে। প্রথমেই ফ্রেশ হয়ে, সব কিছু প্যাক করে শুধু ক্যামেরা নিয়ে বেড় হলাম। আমি আর লিপা মেস এর আসে পাশে ছবি তুললাম। এদিকে সকালে এক কাপ  চা না হোলে আমার দিন শুরু হয় না। তাই আমি আর লিপা বাকিদের বলে চলে গেলাম তৌহিদের বাংলোতে। 
বাংলোর বেয়ারা আমার জন্য চা নিয়ে আসলো, আমি আর লিপা ঘুরে ঘুরে তৌহিদের বাগান দেখলাম। দেখেই বোঝা যায়, বাগানটার অনেক যত্ন নেওয়া হয়। বাগানের এক কোনায় আছে কবুতরের খাঁচা। কিছুক্ষণ পড় এলো ফারুক, তারপর এলো আনিস আর বন্যা। আমরা নাস্তা করে শুরু হোল শেষ ফটোসেশন। সারে আটটায় পাপড়িকে নিয়ে বেড় হয়ে গেল তৌহিদ, আমরা আমাদের ভারা করা মাইক্রোবাস নিয়ে রউনা হলাম বুরিমারির উদ্দেশ্যে।
ফাহাদের বাসায় চা খাওয়াতো হোলই না, সৈয়দপুর থেকে বেড় হওয়ার আগে ওর সাথে কথাও হোল না। 


ডুয়ার্স এর পথে 
সৈয়দপুর থেকে বুরিমারির দূরত্ব ১০৫ কিলোমিটার। আমি এই রাস্তায় এর আগে কখনোই আসি নাই। তাই এই জনপদ আমার জন্য একেবারেই নতুন। আমরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওনা হয়েছি সোয়া নয়টায়। অপরিচিত জনপদে আমি সব কিছুই দেখি আগ্রহ নিয়ে, যদিও সব কিছু দেশের অন্য অঞ্চলগুলোর মতোই। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা শহর থেকে বেরিয়ে গেলাম নীলফামারীর রাস্তা ধরে। 
নীলফামারী ইপিজেড দেখে ডেভিডের কথা মনে পড়ে গেল। ডেভিডের একটা ফ্যাক্টরি আছে এই ইপিজেডে, যেখানে বাঁশ দিয়ে কফিন বানানো হয়, এক্সপোর্টের উদ্দেশ্যে। ডোমার পর্যন্ত সোজা উত্তরে গিয়ে আমরা পূর্বদিকে ডিমলার উদ্দেশ্যে ছুটে চলছি। আকাশ একেবারে শরত কালের মতো পরিষ্কার। আকাশ দেখেই মনে ভাল হয়ে গেলো, ইন্ডিয়াতে পরিষ্কার আকাশ পেলে ছবি তোলা যাবে। এই রাস্তা ধরে আগাতেই তিস্তা ব্যারেজ চোখে পরলো। গাড়িথেকে আমরা সবাই নামলাম, শুরু হোল ফটো সেশন। 
কিশোর বয়স থেকেই তিস্তা ব্যারেজের নাম শুনে আসছি, কিন্তু দেখা হয় নাই। এর উপর দিয়ে পার হলাম। আনিস আর বন্যার অবশ্য এখানে অনেক সুন্দর স্মৃতি আছে। ওরা ওদের কোর্সমেটদের ফ্যামিলিসহ কোন এক পূর্ণিমায় এসেছিল। ব্যারেজের পশ্চিম পাশে খুব সুন্দর একটা বাংলো আছে, ওরা ওখানে ছিল। ব্যাপারটা রীতিমত হিংসে হওয়ার মতো। 
রাস্তার পাশেই একটা চা'র দোকানে থেমে আমরা চা খেলাম। সৈয়দপুর থেকে রাস্তা তেমন খারাপ না, রাস্তায় তেমন ট্রাফিক ও নাই। তবে বুরিমারি পৌঁছানোর শেষ ১০ কিলোমিটার রাস্তা ভয়াবহ রকমের খারাপ। রাস্তার পাশে পাথার নামানো হয় ট্রাক থেকে, ভাঙ্গা হয়, এই অংশটা ভয়াবহ। তবে বর্ডারের কাছে বলে আমাদের উত্তেজনা ছিল অন্যরকম। 
বুরিমারি পৌঁছাতে প্রায় ১২টা বেজে গিয়েছিল। এর মাঝে তান এর কাছে আমার আর ফারুকের একটা সেলফি পাঠানো হয়েছে, যেন চিনতে পারে। কুলি ঠিক করে নিলাম, পাঁচটা ব্যাগ/সুটকেস ২০০ টাকা। ইমিগ্রেশন শেষ করে আমদের ড্রাইভার ইসমাইলকে বিদায় করে দিলাম। এরপর বিজিবি এর চেকপোস্ট পার হয়ে আমরা গেলাম কাস্টমসের কাছে। বুরিমারি বর্ডারে একেকটা অফিস একেকখানে, প্রতিটার দূরত্ব প্রায় ১০০ ফুট। আমরা ট্র্যাভেল ট্যাক্স ঢাকা থেকেই ব্যাংকের মাধ্যমে দিয়ে এসেছিলাম। সুতরাং বর্ডারে আমাদের কোন দালাল লাগে নাই। 
দুপুর একটায় আমরা বর্ডার পার হলাম। তার আগে একটা গ্রুপ সেলফি তোলা হোল। 
একেবারে চেংরাবন্ধা বর্ডারেই দেখা হোল সার্বিক চক্রবর্তী, তান আরে সাথে। তান এর সাথে আমাদের এই ভ্রমণ নিয়ে গত দেড়মাস ধরে যোগাযোগ চলছে। কথা হয়েছে বহুবার কিন্তু এই প্রথম দেখা। চেংরাবান্ধায় ১৫/২০ মিনিটের মধ্যেই আমাদের ইমিগ্রেশন, কাস্টমস আর বিএসএফ এর কাজ হয়ে গেলো। আমরা কাজ শেষ করে এসে দেখি আমাদের লাগেজ গাড়িতে উঠানো হয়ে গেছে। ইন্ডিয়াতে প্রায় গাড়িতে ছাদে লাগেজ বহনের জন্য ক্যারিয়ার থাকে। সব কিছু প্যাক ট্যাক করে আমরা রওনা দিলাম জলপাইগুরি জেলার, ডুয়ার্সের এলিফেন্টা ফরেস্ট রিসোর্টের উদ্দেশ্যে। 
চেংরাবন্ধা থেকেই রাস্তা খুবই ভালো, ডানে বামে চা বাগান। এখান থেকে এলিফেন্টা রিসোর্টের দূরত্ব ৫৬ কিলোমিটার। আমাদের দেশে যেমন মানুষ ধান গম চাষ করে, এখানে সেরকম চা বাগান করে। বর্ডার থেকে শুরু করে ময়নাগুরি হয়ে লাতাগুরি পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে এরকম চা বাগান চোখে পরবে। মানুষের চেহারা দেখে মনে হবে না আপনি অন্য দেশে আছেন, তবে সাইন বোর্ড দেখলে বুঝবেন। বাসা বাড়ি গুলি আমাদের দেশের মতোই। লাতাগুরি থেকে তিলাবারি পর্যন্ত রাস্তাটা প্রায় দশ বারো কিলোমিটার গরুমারা অভয়ারণ্যের ভিতরে দিয়ে। আমাদের বন থেকে এখানের বন একেবারেই ভিন্ন। এই বনের আয়তন ১৩০০ বর্গ কিলোমিটার, গোরুমারায় হাতি, গণ্ডার, গৌর, হরিণ, বুনো শুয়োর, ময়ূর প্রভৃতি পশুপাখি রয়েছে। চোখ কান খোলা রেখেও কিছুই চোখে পড়ল না। বাপ্পা একটা মন্দির দেখিয়ে বলল এটা হাতিদের মন্দির, প্রতিদিন কোন না কোন সময় এখানে হাতি আসে। গোরুমারায় শাল, সেগুন, শিমূল, পলাশ, বহেড়া, পিপল প্রভৃতি গাছ দেখা যায়।
রাস্তায় যেতে যেতে ইন্ডিয়ার সরকার সম্মন্ধে একটা ধারনা দিলো তান, আমরাও একটা ধারনা দিলাম আমাদের দেশের। আমাদের জন্য ঠিক করা এলিফেন্টা রিসোর্ট গোরুমারা জাতীয় উদ্যানের উত্তরে আর চাপামারি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যএর দক্ষিণ পশ্চিমে। রিসোর্ট থেকে কয়েকশ ফুট দূরেই পূর্ব দিকে মূর্তি নদী। মূর্তি নদীর সাথে আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। আমাদের সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচ এর অফিসারদের প্রশিক্ষণ হয়েছিল এই মূর্তিতে, যা এই নদীর পারেই অবস্থিত।

তান আমাদের রুম দেখাল আর বলল আমাদের যেই রুম পছন্দ আমরা সেটাই নিতে পারি। দোতালায়, পূর্ব দিকের ব্যালকনি থেকে ডুয়ার্স এর চা বাগান দেখা যায় এরকম একটা রুমে উঠল ফারুক। আমরা আর আনিসরা পাশাপাশি দুইটা রুমে উঠলাম। আমাদের পূর্বদিকের ব্যালকনি কমন। রুমগুলো সব কাঠের তৈরি। রুমে এসি আছে, ফ্যান আছে। বাথরুমে গিজার আছে, রুমে টিভিও আছে। লাগেজ রেখে আমরা গেলাম লাঞ্চ করতে। 
লাঞ্চের জন্য তান আগেই বলে রেখেছিল মেনু -- মাছ, সবজী, ডাল আর ভাত। এই রেস্টুরেন্টের অনেক ছবি আগে দেখেছি। অনেকটা কল্কে আকৃতির একটা পার বাধানো পুকুরের পাশে এই রেস্টুরেন্ট। এক দিক খোলা- ওই দিক দিয়ে পুরো রিসোর্ট তাই দেখা যায়। গাছ গাছালির মাঝে রিসোর্টের একেবারে মধ্যে একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে। লাঞ্চের পর তান আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিল। আমরা যার যার রুমে চলে আসলাম, বিকেল চারটায় আবার বের হব ঠিক করে। 
দুপুরের ভাত ঘুম আমার অনেক দিনের অভ্যাস। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে ঘুম। এদিকে কয়েকবার ইলেক্ট্রিসিটি গেছে, আমি টের পাই নাই। এর মধ্যে লিপা ফ্রেশ হয়ে বেয়ারাকে বলে আমার জন্য চা আনিয়ে রেখেছে। ঘুম থেকে উঠে ঘর থেকেই ব্যালকনিতে লিপার মুখে আলোটা দেখে ক্যামেরা বেড় করে আগে ছবিতুল্লাম। চা খেয়ে আমরা সবাই রওনা হলাম। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড বাপ্পা। মূর্তি নদীর পার ধরে আমরা মূর্তি ব্রিজের দিকে গেলাম। রাস্তায় যেতে যেতে শুনলাম এই ডুয়ার্স অঞ্চলে স্থায়ী ভাবে ২৫০ হাতি থাকে যাদের প্রত্যেকের নাম আছে। বর্ষার কারণে আসাম থেকে আরও হাতি এদিকে আসায় বর্তমানে ৭০০র উপরে হাতি এই অঞ্চলে আছে। আমার ঠিক আগে এই অঞ্চলে পামিরা আর জাফ্রিনরা ঘুরে গেছে- তারা দুই দলই হাতির দেখে পেয়েছে। 
মূর্তি নদীটা পাথুরে নদী, আমরা যখন দেখেছি তার কয়েকদিন আগেই বৃষ্টি থেমে গেছে, এখন পানি কম থাকলেও- বৃষ্টির সময় এই নদী ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। হাতি যেন লোকালয়ে ঢুকে না পড়ে, তাই নদীর পারে তারের বেড়া দেওয়া আছে, যার মধ্যে রাতে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। এই এলাকার ঘর গুলোর নীচের অংশ টিন দিয়ে মোড়ানো থাকে। এতে করে হাতি এসে লাথি মাড়লে, আওয়াজ হয়। এতেকরে নিজেই ভয় পেয়ে চলে যায়। 
মূর্তি নদী 
মূর্তি ব্রিজের কাছে আমরা নামলাম গাড়ি থেকে। আমাদের দেশের জাফলং তামাবিলের নদীর মতো এই মূর্তি নদী। আমরা যেখানে নেমেছি সেখানে নদীর প্রবাহ পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে, সুতরাং পশ্চিম আকাশের রং, নদীর রং আর পাশের বন মিলিয়ে একটা ভয়াবহ রকমরে সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। এখানে থেকে গাড়ি যাত্রা শুরুর পর পর আমরা চাপামারি বন্যপ্রাণী আরক্ষালয়ে ঢুকে পড়লাম। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে গাড়ির এসি বন্ধ করে কাঁচ নামিয়ে দিলাম। বনের ভিতর থেকে নানা রকমের পোকা আর পাখির শব্দ শুনতে শুনতে আমরা এগিয়ে চললাম। একসময় রাস্তায় হাতির বিষ্ঠা দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে গেলাম। আমাদের ছয়জোড়া চোখে হাতির দেখা পেলাম না। 
ঠিক সন্ধ্যার আগে আমরা গাড়ি থেকে নেমে কিছু ছবি তুলে, ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করলাম। বন থেকে বেড় হওয়ার পর আকাশের রং দেখে আবার গাড়ি থামাতে বলা হোল। ছবিটবি তোলার পরই দেখা দিল বিপত্তি। গাড়ি আর স্টার্ট নেয় না। সবার মধ্যেই একটা বিরক্তি। বাপ্পা আমাদের জন্য আরেকটা জিপ আনালো। প্রায় আধা ঘণ্টা পর আমরা চালসা হয়ে আমাদের রিসোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। চালসা পার হয়েই থামলাম মোমো আর চা খাওয়ার জন্য। 
সারে সাতটার দিকে আমরা রিসোর্টে পৌছালাম। কিন্তু তখন ফারুকের জ্বর জ্বর ভাব, গলা ব্যাথা। রাতে যখন খেতে আসলাম, তখন ফারুকের অবস্থা বেশ খারাপ। লিপার ফার্স্ট এইড, গরম পানি, মশলা চা ইত্যাদি দিয়ে রাতে সবাই ঘুমাতে গেলাম। রুমে পুরনো দিনের এসি, তাই তেমন কন্ট্রোল নাই। কিন্তু শোওয়া সাথে সাথে আমি ঘুম।

ডুয়ার্স থেকে ঝান্ডি 
ঘুম প্রথমে ভেঙ্গেছে প্রচণ্ড শীতে, তখন বাজে রাত সাড়ে তিনটা। উঠে এসি বন্ধ করে আবার ঘুমালাম। রিসোর্টের কম্বলে আমার কোন সমস্যা নাই। যদিও নিচে একটা চাদর হোলে ভালো হোতো। এরপর আবার যখন ঘুম ভাংলো তখন দেখি পোনে পাঁচটা বাজে। ক্যামেরা আর ট্রাইপড নিয়ে বের  হয়ে গেলাম কটেজ থেকে। 
আমাদের কটেজ আর ফারুকের কটেজের মাঝে একটা ওভার হেড ট্যাংক আছে। লোহার সিঁড়ি বেয়ে ট্যাংকের উপরে উঠা যায়। আমি একেবারে উপরে উঠে স্লো শাটার স্পিডে কয়েকটা ভোরের ছবি তুললাম। তখনো চারিদিকে পুরোপুরি আলো ফুটে নাই। কিন্তু সামনের সমান চা বাগানটা মনে হচ্ছিলো সবুজ একটা কার্পেট। দুরে দেখা যাচ্ছে বাঁশ ঝাড়, আরও দুরে বন। এখান থেকে নদীটা তেমন বোঝা যায় না। 
ট্যাংকের উপর থেকে নেমে রিসোর্টের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে ছবি তুললাম। আমি আর লিপা ছাড়া বাকি সবাই তখনো ঘুমাচ্ছে। রিসোর্টের মাঝে যেই ওয়াচ টাওয়ার আছে, সেটায় উঠে এদিক সেদিক ছবি তুলেছি। এর মধ্যে লিপা নামাজ পড়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছে।
আলোটাও পরিষ্কার হওয়ায় ছবি তোলার জন্য সময়টা খুব ভালো ছিল। সবুজের কত রকমের শেড হতে পারে তা এই সময়ে বুঝতে পারছিলাম। রিসোর্টের একটা কুকুর ছিল, সে আমার সাথে সাথে ঘুরেছে। 
একবার ফারুকের কটেজে গিয়ে দেখে আসলাম, সে ঘুমাচ্ছে, রুমে লাইট জালানো। এখানে প্রত্যেকটা কটেজের পূর্ব দিকটা পুরোটা কাঁচের। তাই বাইরে থেকেই দেখা যায়। সকাল থেকে ঘণ্টাখানেক ছবি তুলে আমি একেবারে ঘেমে গিয়েছিলাম। 
আমি ফ্রেশ হতে গেলাম। এই ট্রিপে যতগুলা রিসোর্ট বা হোম স্টেতে ছিলাম, রং টং চা বাগান ছাড়া আর কোথাও বাথরুমে হ্যান্ড শাওয়ার ছিল না। আবার গোসলের জন্য প্রায় প্রত্যেক জায়গাতেই মগ এবং বালতি। এতে আমার তেমন অসুবিধা হয় নাই। এর চাইতে অনেক বৈরি পরিবেশে আমি প্রকৃতির কাজ সেরেছি। শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখি রুমে চা দিয়ে গিয়েছে। এবার চা নিয়ে গেলাম ফারুককে ডাকতে। ও উঠে বলল আজকে ভালো আছে। নামাজ পড়ে সকালে আবার ঘুমিয়ে গিয়েছিল। 
ওর কাছ থেকেই জানলাম গত রাতে বাপ্পা রাত একটায় ফিরেছে। আমাদের আগের দিনের মাইক্রোবাস অন্য গাড়ি দিয়ে টেনে আনা হয়ে কোথাও। রেস্টুরেন্টের বেয়ারা, নামটা খুবই মজার- পুচকি আমাদের জানালো রিসোর্টের গেট দিয়ে বের হয়ে একটু আগালেই নদী দেখা যাবে। লিপা, ফারুক আর আমি বের হলাম। গ্রামের রাস্তা, আসে পাশে তেমন ঘর বাড়ি নাই, একটু আগাতেই চোখে পড়ল চা বাগান। যেটা আমাদের কটেজ থেকে দেখা যায়। চা বাগান দেখে ছবি তোলার লোভ সামলানো অসম্ভব।
এদিকে একটা চা বাগানের ফ্যাক্টরি আছে, তারপর আরেকটা নতুন রিসোর্টের কাজ চলছে, কিন্তু নদী পর্যন্ত যেতে হোলে বেশ খানিকটা কাদা/পানির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। আমরা ওখান থেকেই ফিরে এলাম। ফিরে আসার পথে খেয়াল করলাম, চা বাগানের দিক থেকে আমাদের কটেজ গুলো ছবির মতো লাগে। আমরা যখন ফিরে এসেছি তখন দেখি ডাইনিং এর ওখানে বন্যা, আনিস রুমে গেছে কিছু একটা আনতে। 
আসলে সকালে আনিস আর বন্যা রুমে আটকে ছিল প্রায় আধা ঘণ্টা, ওদের কটেজের সামনে কুকুরটা বসে ছিল। বন্যার কুকুরের ব্যাপারে একেবারে ফোবিয়া আছে। অন্যদিকে আনিস নামাজ পরে, তাই কুকুর ছোঁয়া যাবে না। রুম এর কাঠের দরজা দিয়ে আনিস যতই কুকুরকে ইশারা করে, কুকুর খালি লেজ নাড়ায়, কিন্তু সরে না। ডুয়ার্স এর সকাল ওরা  দুইজন রুমেই কাটিয়ে দিয়েছে। ততক্ষণে ঝরঝরে রোদ উঠে গেছে। 
নাস্তা খেতে খেতে শুনলাম রাতে বন্যা একেবারেই ঘুমাতে পারে নাই, ভয়ে। এই ধরনের অফবিট রিসোর্টে এই প্রথম। বাপ্পা রাতে এসেছে, বেচারা এর আগেও মাত্র আরেকটা ভ্রমণ করেছে। সে  জানালো আমাদের জন্য একটা জীপ আসছে, আমরা সেটায় করে ঝান্ডি যাবো। পথে গরুবাথান নামে একটা যায়গা আছে ওখানে থামব। 
এলিফেন্টা রিসোর্টে ছবি তোলার অসংখ্য যায়গা আছে, তবে আমার মনে হয় সবাই একটা করে অন্তত ছবি ডাইনিং এর পাশের ব্রিজের উপর থেকে তুলে। আমাদের সবাই তুললাম। একটা ব্যাপার খুব অবাক করার মতো, ডাইনিং এর পাশেই এই পুকুর বা ডোবা থাকলেই, এখানে সেরকম মশা চোখে পরল না। এমন কি এখানে কোন কিছু স্প্রে করে নাই।
অনেকদিন থেকেই আমি পিপড়ার ছবি তোলার চেষ্টা করছিলাম। এখানে এদের ওয়াচ টাওয়ারের রেলিং এ দেখি পিপড়ার
সারি। সুতরাং কিছু ভালো ছবি এখানে তুলতে পেরেছি। এখানে ওই সময় আলো  খুব সুন্দর ছিল। আমার জন্য সকালের চা যেরকম জরুরী, দিন শুরু হওয়ার জন্য পাখির ডাকও জরুরী। এখানে ছিল প্রচুর পাখি। একটা প্রজাপতি দেখে তার পিছনে শ-খানেক ক্লিক করে ফেলেছি। কিন্তু ৩০০ এমএম লেন্স দিয়ে প্রজাপতির ছবি তুলতে হোলে সেটা  ১০ থেকে ১৫ ফুটের মধ্যে হতে হবে, প্রজাপতিটা খুব সাবধানে এর বাইরে উড়া উড়ি করছিল।
সারে নয়টায় আমরা আমদের জিপে ব্যাগ উঠানো শুরু করলাম। ২৫০০ সিসি ডিজেল ইঞ্জিনের স্করপিও জিপ। একেবারেই নতুন। আমাদের নেপালি ড্রাইভার প্রদীপ। গ্রাম আর  চা বাগান এর মধ্যে দিয়ে আমরা উত্তর দিকে ছুটে চললাম। চালশা' তে আমাদের প্রথম যাত্রা বিরতি। আমার যেখানেই থামি, সেখানেই ছবি তুলি। এখানে থেকে আবার যাত্রা শুরু করে আমরা থামলাম মিশন হিলে। এখানে প্রকৃত দার্জিলিং চা পান করা যায়, টেস্ট করা যায় এবং কেনা যায়। শত বছরের পুরনো এই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাগান আছে ৯৫১ একর। আমার চাকরী জীবন চা বাগানে হোলেও আমি যে ধরনের চা প্রতিদিন পান করি সেটা দার্জিলিং চা না। সুতরাং
বিক্রেতার কাছ থেকেই বোঝার চেষ্টা করলাম কোনটা ভালো হবে। আমি আর লিপা শেষ পর্যন্ত  মিশন হিল গোল্ড আর মিশন হিল রোস্টেড বাসার জন কিনলাম। আর ওখানে পান করার জন্য মিশন হিল রোস্টেড এর কথা বলেছি। পিছনে একেবারে ছবির মত সাজান এই রেস্টুরেন্ট টা। চা বানানো ইচ্ছে করলে দেখা যায়- এখানে কাপে প্রথমে চা পাতা দিয়ে, তার মধ্যে গরম পানি ঢেলে একটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা হয় পাঁচ মিনিট। এতেই হয়ে গেলো বিখ্যাত দার্জিলিং চা। এই কোম্পানির নিজস্ব ওয়েব সাইট আছে, ইচ্ছে করলে অন্ লাইনে এদের চা কেনা যায়।
আমার চাকরী জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে, আমার প্রথম বস ছিলেন আলম ভাই। আলম ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম উনার চাকরী জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৬৩ সালে এই ডুয়ার্সে। মজার ব্যাপার আলম ভাই এখনো চা বাগানেই আছেন। আমি চা বাগান দেখলেই নস্টালজিক হয়ে যাই। এখানে চা খেয়ে, ছবি তুলে আবার যাত্রা শুরু করলাম। রাস্তার দুই ধারে চা বাগান। চা বাগানের কর্মীরা রাস্তার পাশে বসে দুপুরের খাওয়ার খাচ্ছে। আমাদের জুরী বা কুলাউরা আর এখানে কোন পার্থক্য নাই। গাড়ি বেশ জড়েই ছুটে চলেছে, তাই থেমে ওদের ছবি তোলার আর চেষ্টা করি নাই। 
আমাদের এর পরের যাত্রা বিরতি ছিল গরুবাথান ব্রিজ ভিউ পয়েন্ট। পূর্ব আর পশ্চিমে দুইটা পাহারের মাঝ খাদ দিয়ে  বয়ে গেছে চেল নদী। পাথুরে নদী। রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা নিচে নেমে পানির কাছে যেতে হয়। নেমে গেলাম আমি, অসম্ভব সুন্দর একটা নদী। পানির স্রোত আরে বিশাল বিশাল পাথর। লিপা আর ফারুকও নেমে আসলো পানির কাছে। 
এখানে কিছুটা সময় পার করে আমরা যাত্রা শুরু করলাম ঝান্ডির উদ্দেশ্যে। এর পর থেকে আমাদের পাহার বেয়ে খালি উপড়ে উঠা। সেই উঠা যেন আর শেষ হয় না। লক্ষ করলাম অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা একেবারে মেঘের ভিতরে। এই পুরোটা পথ বন্যা চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। ভয় পাওয়ার মতো একটা রাস্তা। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬,৩০০  ফুট উপড়ে একেবারে মেঘের ভিতরে। মাঝে মাঝে মেঘ একটু পরিষ্কার হয়, আবার হাল্কা বৃষ্টি হয়। 
এখানে আমাদের কটেজটা বেশ মজার, পুরোটা কাঠের, নিচে  দুইটা রুম, উপড়ে আরেকটা রুম। আমি আর লিপা ছিলাম উপরের রুমে। এক রুমে কথা বললে অন্য রুম থেকে শোনা যায়। আবার ফারুকের মোবাইল যেহেতু হট স্পট করা, এই এখানে যার যার রুমে থেকেই ইন্টারনেট পাওয়া যাচ্ছিল। তবে সেটাও নির্ভর করছিল আকাশের উপর। মেঘ একটু পরিষ্কার হোলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল। তবে আমরা যখন এখানে পৌছালাম, তখন ৫০ ফুট দুরের কিছুও দেখা যায় না। 


ঝান্ডিতে এক রাত 
ডুয়ার্স থেকে ঝান্ডির দূরত্ব মাত্র ৫০ কিলোমিটার, কিন্তু উচ্চতা এত বেশী মনে হবে কোথায় আসলাম। ঝান্ডি ইকো রিসোর্টে পাহাড়ের ঢালে ধাপে ধাপে গোটা কুড়ি সুদৃশ কটেজ।। সর্ব মোট ৩৫ জন থাকতে পারে। ডাইনিং রুম আলাদা। এখানে কোন রুম সার্ভিস নাই। কটেজ গুলো কোনটা উপড়ে কোনটা নিচে, পাহারের ধাপে ধাপে। এত মেঘ ছিল পূর্ব পশ্চিম হিসাব করতে পারি নাই। কাঠের সুসজ্জিত কটেজগুলি বেশ আরামদায়ক। পিছনের জানলা দিয়ে দেখা যায় ডুয়ার্সের উপত্যকা। রিসর্ট থেকে উত্তর দিকে দার্জিলিঙের পাহাড়, নাথুলা, এমনকি মেঘমুক্ত দিনে বরফাবৃত কাঞ্চনঞ্জঙ্ঘাও দেখা যায়। 
মেঘের সাথে সাথে আবার একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছে। সমস্যা দেখা দিল, রুমে আমার ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জ দিতে পারছিলাম না। আমাদের কটেজ এর একেবারে সামনেই চা গাছ। একটু নিচে  থেকে দেখলে মনে হচ্ছিল চা বাগানের ভিতরে এই কটেজ। কটেজের আসে পাশে ঘুরে দেখতে দেখতেই দুপুরের খাবারের জন্য ডাক এল। ডাইনিংটা বেশ বড়। ভিতরটা পুরোটা পাইন কাঠের। আড্ডা দেওয়ার জন্য খুব সুন্দর যায়গা। ঝান্ডি ভিউ পয়েন্টটা আমাদের কটেজের একটু উপড়ে। 
দুপুরে খেতে বসে খেয়াল করলাম এখানে দুপুরে ভাতের সাথে পাপর দেয়। পাপার আমি খেয়ে অভ্যস্ত, কিন্তু ভাতের সাথে কিভাবে খায় বুঝতে পারছিলাম না। এর আগের দিন ডুয়ার্স এও দিয়েছিল। আমি পুরোটা আগেই খেয়ে ফেলেছি। অল্প সময় বুঝতে পেরেছি আনিস এর খাদ্য বিষয়ে গভীর জ্ঞান আছে। কিছু খেয়ে বলতে পারে এর মধ্যে কি উপাদান থাকতে পারে। আমরা পাঁচ জনই যেহেতু ডাইনিং এ ছিলাম, তাই আমি আমার মতো করেই  খেয়েছি। আমার প্রত্যেক যায়গায় বাঙ্গালী খাবারই খেয়েছি। 
দুপুরে খেয়ে  দেয়ে আমরা আয়েস করে চা খেলাম। তারপর যে যার রুমে। এত আরামের ঠাণ্ডা আবহাওয়া, দুপুরে ভাত খাওয়ার পর- না ঘুমানো অন্যায়। সুতরাং আমি কম্বলের তলে ঢুকে ঘুম। আবহাওয়ার পরিবিরতন না হোলেও, সবাই এক প্রস্থ কাপড় বদলে ফেলেছে। কিন্তু সমস্যা হোল ভাত ঘুমের পর কাউকে পাওয়া গেল না চা এর জন্য। অবশ্য এরকম যায়গায় এটাই স্বাভাবিক। আমরা একেবারে উপড়ে ঝান্ডি ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে মেঘের ভিতর ছবি তুলছি। ছবি কিন্তু সব একই রকম আসছে, কারণ মেঘের জন্য একটু দূরেই কিছু দেখা যায় না।
কিছুক্ষণ পর পর খোজ নেওয়া হচ্ছে, ডাইনিং এর দরজা খুলেছে নাকি। হঠাত আনিস বলে ঐযে দেখা যায়। সবাই তাকায় দেখি আকাশ একু পরিষ্কার হয়েছে, পাহারের নিচে একটা নদী দেখা যায়। কত নিচে তা হলা মুশকিল। এর পর কিছুক্ষণ মেঘের লুকোচুরি দেখলাম। কিন্তু ওখান থেকে উত্তর-দক্ষিণ বা পূর্ব-পশ্চিম কিছু বুঝি নাই। সন্ধ্যার  ঠিক আগে আগে ডাইনিং এর দরজা খোলায় আমরা গিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকলাম। 
রিসোর্টের একজন স্টাফ ঘরের চার কোনায় সন্ধ্যা পূজা দিয়ে, আগরবাতি জ্বালিয়ে দিল। একটু পর এলো আমাদের পাকোড়া আর চা। রিসোর্টের এই যায়গাটাই শুকনা এবং আরামের। এখানেই আড্ডা চলছিল। হঠাৎ লিপা চিৎকার দিয়ে উঠেছে রক্ত। ওর ডান পায়ে আঠালো কিছু অনুভব করায়, টিসু পেপার দিয়ে পা মুছেছে। তারপর টিসু পেপার এর দিকে তাকিয়ে  দেখে রক্ত। কিন্তু পায়ে কোন ব্যাথা নাই, আমি বুঝে গেলাম জোক। আমি ভালো করে টিসু পেপার দিয়ে রক্ত মুছে বুঝলাম, জোকটা রক্ত খেয়ে পরে গেছে। এখানে হাত ধোয়ার যায়গা বাইরে। সেখানে নিয়ে বন্যা লিপার পা ধুয়ে দিল। লিপা জোককে ভীষণ রকমের ভয় পেত। সবাই যার যার পা ভালো ভাবে দেখে, আমার পায়ে একটা জোক আবিষ্কার করা গেল। সে তখনো রক্তপান শুরু করে নাই। এরপর রাতের খাবার পর্যন্ত আর কেউ ডাইনিং থেকে বেড় হয় না। রাতে রুমে এসে দেখি আমার আরেক পা থেকে রক্ত পড়ছে, মানে জোক ধরেছিল। 
রাতে লাইট জলা মানেই পোকা। এখানে বিচিত্র সব পোকা আর প্রজাপতি। পোকার উপরদ্রপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রুমে বাইরে বাতি জ্বালিয়ে রুমে ভিতরে বাতি  অফ করে রাখলাম কিছুক্ষণ। কাজ হোল, রুমের ভিতরে আর পোকা নাই।  
পাহারের এইসব হোম স্টেতে বা রিসোর্টে রাতের খাবার বেশ তারা তারি। আট বা সারে আটটার মধ্যে রাতের খাবার শেষ। শীতের কারণে এর পর আর তেমন কিছু করার নাই। আর কম্বলের নিচে যাওয়া মানেই ঘুম। ঘুমানোর আগে আবার বন্যাকে সাহস দেওয়া হোল। আজকে সবাই এক যায়গায় আছি। ভয় পেলে যেন ডাক দেয়। এই রুমের মাথার দিকটা পুরোটা কাঁচ। রাতে একবার ঘুম ভেঙ্গেছে, মাথা বেড় করে মনে হোল অসংখ্য জোনাকি পোকা জ্বলছে। তখন আকাশ পরিষ্কার হওয়ায় বুঝা গেলো আমাদের উলটো দিকে একটা পাহার আছে, ওখানকার বাড়িতে যেই আল জ্বলছে, সেগুলোকেই এখান থেকে জোনাকি পোকার মতো লাগছে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এই পাহারের পিছনেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যেত সকালে। 
আকাশে একটু আল ফোটার পর আমি রুম থেকে বেড় হলাম। মেঘের মধ্যে ছবি তুলতে গেলে সমস্যা হয় অটো ফোকাস নিয়ে। তাই সকালে আগে ক্যামেরা ছাড়াই বেড় হয়েছি। দেখলাম একেবারে উপড়ে ভিউ পয়েন্ট থেকে একটা হাঁটা রাস্তা গিয়েছে বনের ভিতরে। আবার রুমে গিয়ে লিপাকে নিয়ে আসলাম, সঙ্গে লিপার মোবাইল আর সেলফি স্টিক। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর লিপা আর ভিতরে যেতে চাইলো না। অনেক রকমের পাখির আওয়াজ পেলেও আমরা দেখা পাই নাই। আকাশ আরেক্টু পরিষ্কার হওয়ার পর পাখি গুলি কে দেখতে পেলেও আর ছবি তোলার চেষ্টা করি নাই। ব্যাটারির অবস্থা নাজুক বিবেচনা করে। 
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কালিম্পং এর চিবো ইন এর জন্য ব্যাগ গুছিয়ে আমরা নাস্তা করতে গেলাম। ঝান্ডির  অভিজ্ঞতা আমাদের সবার জন্যই একেবারে নতুন। অক্টবার বা নভেম্বর মাসে যখন আকাশ পরিষ্কার থাকে, তখন এখানে আসলে একেবারেই অন্যরকম অনুভূতি হবে। 
এবারের ভ্রমণ ঠিক করার সময় আমি জানি ১৫ জুলাই পর্যন্ত পুরো বর্ষা মৌসুম। পুরো ওয়েস্ট বেঙ্গল আর সিকিমে ঘোরার মুল আকর্ষণ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা। এই সময়ে দেখতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। কপাল ভালো থাকলে ঝান্ডি, চিবো আর আহালধারা থেকে দেখতে পাওয়া যাওয়ার কথা। ঝান্ডিতে আমরা রোদের দেখা পাই নাই। তবে আমাদের কপাল ভালো লাগেজ গাড়িতে উঠানর সময় মেঘ মেঘ থাকলেও বৃষ্টি ছিল না।
ঝান্ডি থেকে আমরা দেলো, কালিম্পং সাইন্স সিটি হয়ে চিবো ইনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। 


কাঞ্চন জঙ্ঘা
ঝান্ডি থেকে রওনা হওয়ার পর লিপার খেয়াল হোল, একটা ব্যাগ ফেলে এসেছে। ঠিক ওই সময় রিসোর্ট থেকে আবার ফোন করেছে বাপ্পার কাছে-যে আমরা একটা ব্যাগ ফেলে এসেছি। অল্প একটু জায়গার মধ্যে পাহাড়ের ঢালে প্রদীপ জিপ ঘুরিয়ে আবার উপরে উঠলাম। জিপের সামনের সিটে ছিলাম আমি। মাঝের সিটে লিপা, বন্যা আর আনিস। একেবারে পিছনে বাপ্পা আর ফারুক। আঁকা বাঁকা, উঁচু নিচু এই রাস্তায় একেবারে পিছনের সিটে কি অবস্থা হতে পারে, কিছুটা অনুধাবন করা যায়। আমি মৃদু ভাবে দুই একবার ফারুককে সামনে আসার প্রস্তাব দিলেও, সে দৃঢ় ভাবে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। 
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সাপের মতো নিচে নামার পর, প্রদীপকে বলা হোল চা খাবো আর বাথরুমে যাবো। সেই অনুযায়ী কালিম্পং শহরের একটু আগে পাইন বনের ধারে একতা দোকানে আমরা থেমেছি চা খাওয়ার জন্য। এই অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেক বাসাতেই কুকুর পুষে। সব কুকুরই খুব নাদুস নুদুস। আর বন্যার যেহেতু ফোবিয়া- বেচারা যেখানেই যায় সেখানেই আতংক। চা পর্ব আর ছবি তোলা পর্ব  শেষ করে আমরা গেলাম দোলে ভিউ পয়েন্টে। 
এখানে ঢুকতে ১০ রুপি করে টিকেট কাটতে হয়। পার্কের ভিতরে অনেক খানি হেঁটে মুল ভিউপয়েন্টে যেতে হয়। হাঁটা রাস্তার এক ধারে সার সারি হাইড্রাঞ্জিয়া ফুল। আর কিছুদিন আগে এলে এই যায়গাটা একেবারে রঙ্গিন দেখা যেত। 
আমরা যখন ভিউপয়েন্টের একবারে উপরে, তখন আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। নীচের পাহাড় গুলোর কোথাও কোথাও রোদ পড়ছে। একেবারে নীচে দেখা যাচ্ছে তিস্তা  নদী। প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার উত্তেজনা কেটে যাওয়ার পর টেরপেলাম বেশ কষ্ট হয়েছে এই পর্যন্ত আসতে। কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম সবাই। ওখানে একটা বেঞ্চ আছে। এই খানেও সেই একই কথা, দিন পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। আমরা অনেক চেষ্টা করেও কিছুই দেখলাম না। 
এর পর গেলাম সাইন্স সিটি কালিম্পং। এটা বেশ মজার একটা জায়গা। এই জায়গাটা বাচ্চাদেও সবচেয়ে বেশী ভাল লাগবে। বিজ্ঞানের  সূত্রগুলো ব্যাবহারিক ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি আর লিপা প্রথমেই একেবারে উপরে উঠে দেখি সেখানে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। চা খেতে খেতে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম আর খেয়াল করলাম আমার ক্যামেরার ব্যাটারি একেবারে শেষ।     
অবশেষে প্রায় দেড়টার দিকে আমরা কালিম্পং শহর থেকে পাঁচ কিলিমিটার দুরে চিবো ইন এর নীচে পৌছালাম। আগের পড়াশোনা থেকে জেনেছিলাম এখানে গাড়ি থেকে নেমে তারপর প্রায় ১৫০ সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে হয়। তবে উপরে উঠার পর আর তেমন কষ্ট মনে হয় নাই। তবে অবাক হয়ে গেলাম আমাদের লাগেজ, মানে পাঁচটা ভারি সুটকেস এক ৭৭ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ উপরে উঠালো। আমাদের একবার উঠলেই আধা ঘণ্টা বিশ্রাম লাগে। 
চিবো ইন একটা হোম স্টে, যার উত্তরে কাঞ্চন জঙ্ঘা আর সিকিম। পশ্চিমে দার্জিলিং এর টাইগার হিল দেখা যায়। নীচে তিস্তা নদী আর কালিম্পং শহর। বড় চার কোনা একতা টাইলস করা উঠান, উঠানের এক কোনে আড্ডা দেওয়ার একটা বিশেষ স্থান। সেখানে চারদিকে বেঞ্চের মতো করা, উপড়ে কুশন আছে। আরও আছে পাঁচটা ছোট কুশন। এখানে বসে মাথা উঁচু করলেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। তবে আমরা যখন পৌঁছিয়েছি- কাঞ্চনজঙ্ঘাটা তখন পর্যন্ত গল্প। ঝকঝকা রোদ ছিল, কিন্তু দক্ষিণ সিকিমের পাহাড়ে পর আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। 
পশ্চিম দিকে একটু নীচে এদের ডাইনিং। সাগর আর দীপিকা বৌদি এখানে গেস্টদের দেখা শোনা করে। মজার ব্যাপার হোল আমাদের আনিস এর ডাক নাম সাগর। অন্যদিকে দীপিকা আর বন্যা দুজনেরই জন্মদিন ৩১ জুলাই। দুপুরে খাওয়ার পর আমি আর রুমে যাই নাই। তবে রুমে লিপার জন্য হেয়ার ড্রায়ার ঠিক করতে গিয়ে দেখি আমার ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জ হচ্ছে। খুব খুশি হয়ে গেলাম। আমি আড্ডার ওই বেঞ্চে শুয়ে দুপুরটা কাটিয়ে দিলাম। 
এর মাঝে কয়েকদফা চা হয়ে গেল। চিবো পুরো গ্রামটাই অরগানিক। বিকালের দিকে মিষ্টি আলোয় বিভিন্ন ঢঙে ছবি তোলা হোল। এর পর আবার এলো মোমো আর চা। বন্যাকে না জানিয়ে কালিম্পং থেকে একটা কেক আনানোর বাবস্থা করা হোল। সূর্য পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার পর দক্ষিণ সিকিমের পাহাড়ের ঢালে মনে হচ্ছিল হাজার হাজার জোনাকি। 
ফারুক কেক নিয়ে ফিরে আসার পর এটা লুকিয়ে রাখা হোল ওর রুমে। রাতে খাওয়ার পর আবারো চলছে আড্ডা। আমি তখন বেঞ্চে শুয়ে খেয়াল করলাম, ওখান থেকে একশো দেখা যাচ্ছে, আর আকাশে অনেক তারাও দেখা যাচ্ছে। এটা আমার খুব শখ ছিল, পাহাড় চুড়ায় শুয়ে শুয়ে তারা দেখবো। চিবো ইনে দুইটা কুকুর আছে, একটার নাম ব্লাকি, আরেকটার নাম মনে নাই। অল্প সময়েই আমি ব্লাকির সাথে ভাব করে ফেলেছি, আর অন্যদিকে বন্যা আছে চরম আতংকে। 
রাতে ঘরে ঢুকে তারপর মনে হোলো, ১২টা পর্যন্ত কেউ জেগে থাকতে পারবে না, তাই একটু আগেই আমরা বন্যার জন্মদিন করে ফেলি। একতালা থেকে দোতালায় ফারুক কে ম্যাসেজ করলাম, চলো আগেই কেক কেটে ফেলি। ও নীচে নাম্বার পর আবার টেবিল সাজিয়ে তারপর বন্যা আর আনিসকে ডাকা হোল। বন্যা একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছে, নাম লেখা কেক এই পাহাড়ে দেখে। প্লেন এর টিকেট আমি কাটার সময় খেয়াল করেছিলাম বন্যার জন্মদিন আমাদের ভ্রমণের মাঝে, তাই তানকে  বলেছিলাম এরকম কিছু করা যায় নাকি। বন্যার জন্য এটা ছিল একটা বিশাল সারপ্রাইজ। 
সকালে লিপা বলল সারারাত কুকুর দুইটা আমাদের দরোজার বাইরেই চিল্লাচিল্লি করেছে, কিন্তু আমি রুম থেকে বেড় হওয়ার পর থেকে এরা চুপচাপ। পূর্ব দিকে উঁচু পাহাড় থাকায় সকাল সাতটার আগে এখানে রোদ এর দেখা পাওয়া যায় না। কিন্তু ধীরে ধীরে সকাল হওয়া দেখতে অসাধারণ লাগে। বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিতেও ভালো লাগে। এই হোম স্বত্বের মালিক মিলানদা আমাদের একটা ছবি দেখালেন, কোথায় কাঞ্চনজঙ্ঘ দেখা যায়।     


চিবো থেকে আহালধারা 
সকাল বেলা আমার ক্যামেরার ব্যাটারি যেহেতু পুরো চার্জ আছে, তাই সব কিছুর ছবি তুলছি। মিলনদা তার নিজের সম্বন্ধে বলছেন। আমাদের হোম স্টে র নীচে উনার একটা ছোট মুদি দোকান আছে- যেটাকে উনি বলেন টাইমপাস  দোকান। ওখানে ঘণ্টাখানেক বসে তারপর উনি উনার প্রজেক্ট এর কাজ যেখানে হচ্ছে সেখানে চলে যান। মূলত কন্ট্রাক্টরি উনার বিজনেস। মিলনদার স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী। সুখি পরিবার- স্বামী স্ত্রী, ছেলে ছেলের বৌ আর নাতী। 
সকালে কাকাকে দিয়ে আমি চা যোগাড় করে ফেলেছি। এর মাঝে হঠসৎ মিলনদা বললেন ঐযে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। উত্তর দিকে দৃষ্টির  সীমা রেখায় খেয়াল করলাম দক্ষিণ সিকিমের পাহাড়ের পিছনে সাদা টুপি পরা কয়েকটা পাহাড়ের চুড়া দেখা যায়। কাঞ্চনজঙ্ঘার যতগুলো ছবি দেখেছি, সেগুলোর সাথে এটা মিলে যায়। আমরা সবাই উত্তেজিত। আনিস তখনো রুম থেকে বের হয় নাই। তাকে রুম থেকে ডেকে বের করা হোল। 
ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়া হোল, হোয়াটস অ্যাপে জানানো হোল। পিছনে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেখে ছবি তোলা, কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি তুলছি, এরকম ছবি তোলা হোল। আমদের উত্তেজনা দেখে অনেকেই ভাবতে পারে আমরা এভারেস্ট জয় করে ফেলেছি। উত্তেজনা না হওয়ার কারণ নাই, এরকম কখনো ভাবি নাই যে রুমের দরজা খুলে বের হলেই সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে। পামি একবার লিপার সাথে যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছে, আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেয়েছি নাকি- লিপা সগর্বে জানিয়ে দিল, আমরা দুই ঘণ্টা যাবত দেখছি। উত্তরে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর পশ্চিমে দেখা যাচ্ছে টাইগার হিলের চুড়া। 
৩১ তারিখে সকালের নাস্তা ছিল পুরি আর ছোলাবাঁটুরা। এটা আমার অন্যতম পছন্দের একটা সকালের নাস্তা। নাস্তা আর চা খেয়ে আমরা আবারো আড্ডার স্থলে আড্ডাবাজি করছি। এই সময় দুই ভাবীর কোন এক ভাবী আবিষ্কার করল, ফারুক এই ভ্রমণে আসার পর থেকে 'সেই মেয়ে' নামে পোস্ট দেয়। আমার সাথে যেহেতু ফেইসবুক নাই, সুতরাং দুই ভাবী এবং দেবরের হাসাহাসিতে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত ভূমিকা পালন করতে হচ্ছিল আমাকে। তবে যেটা বুঝলাম ৩৭ বছরের যুবক ফারুক রোমান্টিক কোন ঝামেলায় আছে। 
ফারুক ফটোগ্রাফার হিসাবে যেরকম সচেতন, নিজে মডেল হিসাবেও সচেতন। একটা ভালো ছবি তোলার জন্য অনেক কষ্ট করতে পারে। সাধারণত কোথাও গেলে আমার ছবি তেমন থাকে না। আমার থাকলেও আমার আর লিপার একসাথে ছবি তেমন থাকে না। এবার তার বাতিক্রম- ফারুকের কারণে। ফারুকের সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে ওর হিউমার। সবাইকে হাসিয়ে রাখতো সারাক্ষণ। 
সকাল দশটার দিকে আমরা বেড় হলাম চিবোইন থেকে। তবে মনে হচ্ছিল এখানে আরেকটা দিন থাকলে ভালো হোত। আবার সেই আঁকাবাঁকা পথ। এবারের গন্তব্য লাতপাঞ্চর এলাকায়, আহালধারা। চিবো ইন থেকে নেমে আসার পর প্রথমেই আমরা থামলাম রিসি রোডের উপর তিস্তা ব্রিজে। এই ভ্রমণে তিস্তা নদীকে আমরা তিনটি স্থানে পার হয়েছি। মনে করার
চেষ্টা করছিলাম আরও অনেক দক্ষিণে তিস্তা ব্যারেজের উপর এই নদীটাই পার হচ্ছিলাম। ব্রিজের উপর রঙ্গিন প্রার্থনা পতাকা টাঙ্গানো ছিল। এই ধরনের প্রার্থনা পতাকা সারা পাহাড়ি অঞ্চলেই চোখে পরবে। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করে এই প্রার্থনা পতাকা থাকলে তাদের মংগল হবে, তাই পুরো হিমালয় জুড়েই এদের দেখা মিলবে।
ব্রিজ পার হয়ে একটা লম্বা সময় তিস্তা নদীর পার বেয়ে দক্ষিণ দিকে আগালাম। রাস্তার ডান দিকে খারা পাহাড় আর বাম পাশে কয়েকশ ফুট নীচে তিস্তা নদী। এখানে তিস্তা নদী দেখলে বোঝা মুশকিল এই নদী এতো শান্ত হতে পারে, যখন
বাংলাদেশে ঢুকছে। কালিজহরা নামে এক যায়গায় এসে আমরা পশ্চিম দিকের পাহাড়ে উঠা শুরু করলাম। যতই উপড়ে উঠছি ততোই মেঘের ভিতরে ঢুকে পড়ছি। কোথাও কোথায় ঘন পাইন বন। পাইন বন এত ঘন, যে বনের নিচে মাটিতে কখনো সূর্য পরে বলে মনে হয় না। যায়গায় যায়গায় বিভিন্ন ফার্ন পাহাড় থেকে রাস্তার উপর ঝুলে আছে। 
পাথুরে রাস্তা, বৃষ্টির কারণে কোথাও কোথাও উপরের চলটা উঠে গেছে। কিন্তু আমাদের বাহন আমাদের ঠিকই  উপরে তুলে ফেললো। রিসোর্ট থেকে কয়েকশ গজ দুরে আমাদের গাড়ি থেকে নামতে হয়েছে। শেষ অংশ টুকু আর এই জিপ যেতে পারবে না। ততক্ষণে আমরা মেঘের ভিতরে। এখানের রিসোর্টটা একেবারে পাহাড় চুরায় একটা  সমতল মাঠ আছে, সেটার পশ্চিম ধারে তিনটা কাঠের বাংলো। প্রতি বাংলোর মাঝে প্রায় ৩০ ফুট দূরত্ব। প্রতিটা কটেজে, দুইটা বিছানা, একটা কম্বল আর সঙ্গে বাথরুম। 
কটেজের পূর্ব দিকে একটা ছোট্ট বারান্দা। কটেজের ফ্লোর আর বাইরের উঠান প্রায় একই সমতলে। বাথরুম পরিষ্কার তবে এখানে গিজার নাই, পানি গরম করার আলাদা হিটার আছে। আনিস আর বন্যা একেবারে প্রথম কটেজে, যেটা দক্ষিণে, মাঝেরটায় ফারুক, বাপ্পা আর প্রদীপ, আর একেবারে উত্তরের কটেজে লিপা আর আমি। রুম বরাদ্দের পর মেঘের মধ্যে ঘুরে ঘুরে এলাকাটা বোঝার চেষ্টা করলাম। এইটাও একটা চা বাগানের অংশ। স্থানীয়রা শীতকালে এইটা পিকনিক স্পট হিসাবে ব্যাবহার করে। কিন্তু মেঘ আর বাতাসের কারণে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। 
খাবার ঘরটা সমতল মাঠের ঠিক উল্টো দিকে, মানে পূর্ব কোনায়। এর মাঝেই দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হোল। খাওয়া আর আড্ডার মেঝেই এক মজার ঘটনা লক্ষ করলাম। দরজা দিয়ে মেঘ ঢুকে জানালা দিয়ে বেড় হয়ে যাচ্ছে। এরকম অভিজ্ঞতা আগে হয় নাই।  মেঘের কারণে সব কিছু ভিজা ভিজা লাগছিল। আমি ব্যাটারি চার্জে দিয়ে চলে গেলাম ঘুমের রাজ্যে। 
ব্রাজিলের জার্সি পরিহিত আমাদের নেপালি বেয়ারা এসে চা দিয়ে বলল, আকাশ পরিষ্কার হয়ে আমি চাইলে নীচে তিস্তা নদী দেখতে পারবো। আম চা আর ক্যামেরা নিয়েই বেড় হয়ে গেলাম। লিপা আর বন্যা দেখি অন্য কটেজের বারান্দায় গল্প করছে। খাবার ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে  আমি অবাক হয়ে গেলাম। ছবির মতো লাগছে, নীচে তিস্তা নদী। আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাওয়াতে খেয়াল করলাম ওখানে তিনটা চুরা, একটাকে বলে ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পয়েন্ট, আরেকটা রকি মাউন্টেইন ভিউ পয়েন্ট, আরেকটার নাম জানতে পারি নাই। এখান থকে দক্ষিণ আর পূর্ব দিকের সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। 
তিস্তা নদীর উপর ওদের চার নাম্বার পাওয়ার প্ল্যান্টটা একে বারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। এখনে  সেইফটি সাইন বোর্ড চোখে পরলো না। পাহাড়ের একেবারে কিনারে হাল্কা একটা বাঁশের বেড়া আছে। নিরাপত্তার ব্যাপারটা নিজস্ব। কারো যদি উচ্চতা নিয়ে ফবিয়া থাকে এখানে যাওয়া উচিৎ না। ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পয়েন্ট এর পূর্ব দিকে আরেকটা ভিউ পয়েন্ট আছে, বেশ ঘুরে যেতে হয়। গেলাম সেখানে, সেখান থেকে আমি  আনিস আর বন্যার ছবি তুললাম- ওড়া তখন ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পয়েন্টে। পাহাড়ের তুলনায় একেবারে লিলিপুটের মতো লাগছিল। আমার পিছনে পিছনে লিপা আর ফারুকও এখানে চলে আসলো। 
এখানকার দৃশ্য বর্ণনা করা যায় না, ছবি তুলে দেখানো যায় না। এটা অনুভব করতে হয়। বেশ কিছুক্ষণ ছবি তুলে তারপর উপড়ে উঠে আসলাম। এই প্রথম আমি কোন যায়গায় লেন্স বদল করে দুই লেন্সেই ছবি তুলেছি। তখন আলোটা খুব সুন্দর ছিল ছবি তোলার জন্য। সরাসরি সূর্য নাই, অথচ আলো আছে। ধুলা না থাকায় সবুজ পাতা গুলো একেবারে চক চক করছিল। যে কোন পাহাড়ের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছিল সবুজ কত প্রকার ও কি কি। 
সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫,০০০ফুট উপড়ে এই আহালধারা ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পয়েন্টে আমি আর আনিস সস্ত্রীক কয়েকটা ছবি তুললাম। এই চুরার পশ্চিম দিকে আরেকটা চুরা আছে, যেটাকে রকি মাউন্টেইন ভিউ বলে। দুই চুরার মাঝের অংশটা ইংরেজি জে অক্ষরের মতো। বেশ খানিকটা ঢাল বেয়ে নেমে তারপর আবার উঠতে হবে। এখানে একটু আগেই মেঘ ছিল তাই ঘাস ছিল ভিজা। বাপ্পা সবার  আগে নেমে গেল, তার পিছনে আমি। আমার গেল পা পিছলিয়ে। এক হাতে ক্যামেরা, গলায় ঝুলছে লেন্স এর ব্যাগ। পল্টি খেয়ে পরার আগেই হাঁটু দিয়ে আটকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছি। এখানেও চুরার কিনারে গেলে রীতিমত ভয় লাগে। 
কিন্তু চুরায় উঠে প্রথমে দেখি ক্যামেরা অন হয় না। তারপর ব্যাটারি বেড় করে আবার ঢুকিয়ে অন্য করলাম দেখি অন্ হয়েছে। কিন্তু এরর দেখাচ্ছে। এবার মেমোরি কার্ড বের করে আবার ঢুকালাম। দেখি কাজ করছে। পিছলে গিয়ে যতটা না ভয় পেয়েছিলাম, ক্যামেরা নিয়ে তার থেকে বেশী ভয় পেয়েছি। ছবি তুলে আবার উপড়ে উঠে আসলাম। তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। নাস্তা হিসাবে এল পাকোড়া আর চা। 
যেহেতু এই ভ্রমণে কাঞ্চন জঙ্ঘা দেখা, আর মোটা মুটি ভালো আবহাওয়া পাওয়া গেছে, তাই নিজেকে পীর দাবি করে অন্যদের কাছে সমর্থন চাইলাম। কেউ দিলো না। এরপর পাথরের উপর বসে পীর এর মতো করে একটা ছবি তুলে  ফেলেছি। সন্ধ্যায় আমাদের মুল আকর্ষণ ছিল বন-ফায়ার এবং বার বি কিউ। এটা ছিল তান এর পক্ষ থেকে উপহার। ভাগ্য ভালো থাকায় তখন বাতাস থাকলেও, বৃষ্টি বা মেঘ ছিল না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হওয়ায় আগুণের পাশে বেশ আরাম লাগছিল। 
বার বি কিউ হতে হতেই খেয়াল করলাম দক্ষিণ পশিম দিকে রাতের শিলিগুড়ি শহর দেখা যাচ্ছে। এটা এক ভিন্ন রকমের দৃশ্য। দুরে শহরের  উপরের আকাশে একটু লালচে আভা, আর নীচে অসংখ্য জোনাকি পোকা। শহরের উত্তরে বাগডোগরা এয়ারপোর্টের আলোগুলো স্পষ্ট বুঝা যায়। ট্রাইপড থাকায় লং এক্সপোজারে ছবি তুললাম। ডাক এলো বার বি কিউ হয়ে গেছে। সবাই হামলে পড়লাম প্লেটের উপর। শুধু পেয়াজ দিয়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কাবাব শেষ। আনিস বার বি কিউ খেয়ে এতোই খুশি,  সে গিয়ে বেয়ারাকে বকশিশ দিয়ে এসেছে। 
এই রিসোর্টে রান্না করেন মূলত একজন নেপালি দিদি। উনি থাকেন রিসোর্ট থেকে প্রায় সারে তিন কিলোমিটার দুরে। সুতরাং আমরা রাতের খাওয়ার শেষ করলে উনি চলে যাবেন। আমরাও তাই আর খুব একতা দেরি করলাম না। রাতের খাবার খেয়ে চা খেয়ে চলে এসেছি। সারা শরীরে ছিল পাহাড় বাওয়ার ক্লান্তি। কাপড় পালটে  বিঝানায় যাওয়ার সাথে সাথেই আমি ঘুম। 


গন্তব্য রং টং চা বাগান
সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে বৃষ্টির শব্দে। বাইরে তখন একটু একটু আলো ফুটছে। সিগারেট নিয়ে দরজা খুলে দেখি বৃষ্টির জন্য কিছুই দেখা যায় না। একেবারে সোজা হয়ে বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের পরে গন্তব্য রং টং চা বাগান। সেখানে গাড়ি থেকে নাম্বার পর অনেকখানি নাকি হেটে নামতে হবে। পোর্টার নাই, সুতরাং নিজেদের লাগেজ নিজেদের বহন করতে হবে। আগেই ঠিক করেছি আমি আর লিপা একটা লাগেজ প্যাক করবো, সেটা নিয়ে ওখানে যাবো। বাকি সুটকেস গাড়িতে থাকবে। আমরা সেই ভাবে লাগেজ প্যাক করে ফেলেছি। আগের রাতে শুনেছিলাম সকাল সাড়ে চারটায় আকাশ পরিষ্কার থাকলে সূর্য উঠার দৃশ্যটা অসম্ভব সুন্দর দেখা যাবে। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য হয় নাই সেটা দেখার।
পুরো রেডি হয়েই আবার শুয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে বাপ্পা এসে আরেক খবর দিল, রং টং যাওয়া যাবে না, রাস্তা কোন এক খানে ভেঙ্গে গেছে। তাছাড়া আমরা যেখানে যাবো, বাপ্পা বা আমাদের ড্রাইভার প্রদীপ আগে কখনো যায় নাই। বাপ্পার টেনশন বেড়ে গেল। একে ফোন করে ওকে ফোন করে। এর মধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে। বাপ্পা তান এর সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলো না।
আমরা নাস্তা শুরু করার আগেই তানকে পাওয়া গেল। সে কনফারেন্সে কলে হোম স্টে'র মালিক উৎসকে যুক্ত করল। উৎস রাস্তা বাতলে দিল প্রদীপকে। আমাদের টেনশন শেষ হোল। এই অঞ্চলের রাস্তা অনেকটা মাকড়শার জালের মতো। যে কোন এক জায়গায় রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে, গন্তব্যে পৌঁছানোর আরও সুযোগ থাকে। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় আমাদের গাড়িতে উঠতে সমস্যা হোল না।
আঁকা বাঁকা পথ ধরে শুরু হোল নীচে নামা। কালিজহরা পর্যন্ত নাম্বার পর আবার দক্ষিণ দিকে রওনা হলাম। পাশে তিস্তা
নদী। কিছুক্ষণ চলার পর রাস্তার পাশে টয় ট্রেনের লাইন চোখে পড়ল। আমাদের হোম স্টের নাম টিডি, এদের বাইরে ছোট্ট একটা সাইন বোর্ড, কাঠের দেওয়ালের উপর। রাস্তা থেকে চোখে পরে না। প্রদীপ আর বাপ্পা টেলিফোনে কথা বলে অবস্থা সনাক্তের চেষ্টা করছে। সোনাডা স্টেশন এর আসে পাশেই হওয়ার কথা, কিন্তু আমরা পেলাম না।
একে ওকে জিজ্ঞেস করে, সামনে পিছে ঘুরে অবশেষে আমার টিডি'র সন্ধান পাই। একটা শর্টস আর জ্যাকেট পরে সৌরভ গেটে দাঁড়িয়ে ছিল। পাইন কাঠের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই দেখি বিশাল সাইজের দুই কুকুর আর হোম স্টে'র মালিক উৎস প্রধান। উৎস আমাকে জিজ্ঞেস করল, দুপুরে কি খাবো। আমরা আগেই ঠিক করেছিলাম দুপুরে আমরা কোন রেস্টুরেন্টে খাব। টিডি হোম স্টে, রং টং চা বানাগের এক কোনায়। উৎস আর স্ত্রীর এক স্বপন রাজ্য।
টিডি যেই এলাকায় অবস্থিত তাকে বলে আট মাইল। এখান থেকে টাইগার হিল এর দূরত্ব দশ কিলিমিটার। আমরা টিডি থেকে একটু সামনে এগিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেলাম।
অবশেষে দুপুর একটার দিকে আমরা আবার টিডি তে ফিরে এলাম। আকাশ তখন পরিষ্কার। এমনকি রোদও আছে। আমি আগে ঢুকেই সৌরভের সাথে পড়ছয় হোল। সে পেশাগত ভাবে একজন স্থপতি। এই হোম স্টে'র ডিজাইন এর দিকটা মূলত দেখে। তাকে বলে কুকুর দুইটা চুঙ্গি আর কোকো' কে আটকানো হোল। আমাদের যদিও বলা হয়েছিল এখানে পোর্টার পাওয়া যাবে না, উৎস জানিয়ে দিল আমাদের লাগেজ টানতে হবে না, ওদের লোক আছে। ২১২টা পাথুরে সিঁড়ি ভেঙ্গে আমরা স্বপ্নের কুড়ে ঘরে আসলাম। পাথরের ধাপ গুলোর উপর কিছুদিন পর পর কাঠের গুড়া দেয়। এতে করে এই সিঁড়ি ভিজা থাকলেও, পিচ্ছিল হয় না।
উপরের অফিস আর নীচের কুরে ঘরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় একটা জায়গা আছে, এখানে বিশ্রাম নেওয়া যায়, রাতে বার বি কিউ করা যায়। করে ঘরটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি। দুইটা রুম, একটা বাথ রুম। রুমের সমস্ত আসবাব বাঁশের তৈরি। ছাদ শণ আর লেমন গ্রাসের তৈরি। রুমে হালকা আলো জ্বলছে, আবার ছাদের একটা অংশ স্বচ্ছ হওয়ায় ওখান দিয়েও আলো আসছে। পাইন বনের ভিতরে দেখে টপ টপ করে পানি পড়ছে, সেই শব্দ সারাক্ষণ হচ্ছে। ড্রেসিং টেবিল, আলনা, সব কিছুই বাঁশের তৈরি। মেঝেতে আমাদের শীতল পাটির মতো একটা পাটি। পানি গরম করার জন্য ইলেকট্রিক কেতলি। পানির জন্য একটা মটকা, সেটায় আবার একটা কল লাগানো আছে। কয়েকটা মগ, চা পাতা আর চিনি। ইচ্ছে করলে নিজেই চা বানিয়ে খাওয়া যাবে।
বাথরুমের মেঝে পাথরের, দেয়াল কাঠের আর ছাদ স্বচ্ছ। আধুনিক একটা বাথরুমে যা যা থাকার কথা এখানে প্রায় সব কিছুই আছে। মনে হবে প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতির ডাকে সারা দিচ্ছেন। ওয়াই ফাই আছে।
কুরে ঘুরের বাইরের দিকে একটা ছোট্ট বারান্দা আছে, যেখানে ছয় সাতজন সুন্দর আড্ডা দিতে পারবে। ঘর থেকে বের হলেই মনে হবে আপনি প্রকৃতির ভিতরে আছেন। এই ঘরের আসে পাশে, এলাচ, কাঠ বাদাম আর জলপাই গাছ এর বাগান মনে হবে। সারাক্ষণ একটা বৃষ্টির শব্দ পাবেন, যেটা আসলে কুরে ঘরের সাথেই বয়ে যাওয়া ঝর্না। এই পরিবেশে ভাত ঘুমের কথা ভুলে গিয়েছি। চা বানিয়ে খেয়েছি আর গল্প করেছি। মাটির ঘর আর বৃষ্টির দিন হওয়ায় সবকিছু স্যাঁতসেঁতে হওয়ায় এখানে আসার পর পর লিপা আর আনিস এর মাথা ধরে গেছে। একটা ইলেকট্রিক হিটার ছিল, ঘরের আদ্রতা কমানোর জন্য।
বিকেল চারটার দিকে সৌরভ আরো দুইটা ছাতা নিয়ে নিচে নেমে আসলো। সে প্রথমে আমাদের জানালো এই ঘরটা কি কি উপাদান দিয়ে বানানো হয়েছে। যেখানে এই কুরে ঘর এক সময় এলাকার লোকজন এখানে ময়লা ফেলত। এই যায়গার মালিক উৎস নিজে ব্যাক প্যাকার ছিলেন। তার আকর্ষণ পারমাকালচারের (permaculture) এর উপর। এই বিষয়ে পড়াশোনা করে ঠিক করেন ময়লার ভাগারকে তিনি একটি জৈব বাগানে রূপান্তর করবেন। এখান থেকে হাজার হাজার বস্তা পলিথিন তিনি অপসারণ করেন। বর্তমানে উনার এই হোম স্টে জিরো ওয়েস্ট পলিসি অনুসরণ করে। প্রতিটি ঘরে ময়লা ফেলার ঝুরিতে দুইটা পালস্টিকের বোতল আছে আর একটা লাঠি আছে। প্রথমেই দেখিয়ে দেয়, প্লাস্টিকের বোতলে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মোড়ক এই বোতলে ঢুকিয়ে লাঠিটা দিয়ে চেপে দিতে হয়। এই ভাবে বোতলটা ভরে গেলে, এটাকে দিয়ে ইটের কাজে ব্যাবহার করা যায়।
সৌরভ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাল, মাটির ঘরে খালি পায়ে থাকাটা স্বাস্থ্য সম্মত। সামনে যেই পানির ঝর্না এই পানির উৎস আসলে গাছের শিকড়। গাছের শিকড় প্রয়োজনে পানি ধরে রাখে অথবা ছেড়ে দেয়। আমাদের কুরে ঘরের পিছনে একটা বড় পাথরের আড়ালে একটা শিব মন্দির আছে। এই পাহাড়ের খাদে সকালের রোদ গাছের ফাঁক দিয়ে এখানেই প্রথম আসে। তাই মন্দিরটা এখানে। মন্দির স্থাপনের আরকেটা কারণ হচ্ছে, আগে এখানে ময়লা ফেলা হোতো, আসে পাশের লোকজন এইখানে মন্দির হওয়ার ফলে যায়গাটাকে পুণ্য ভূমি মনে করে।
সৌরভ আমাদের নিয়ে জঙ্গল ধরে আরও নিচে নিয়ে গেল। একদম নিচ দিয়ে একটা পাহাড়ি নদী বয়ে যাচ্ছে। উৎস তার স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে এই নদীও প্লাস্টিক মুক্ত করেছে। টিডি'র নিজস্ব জৈব বাগান আছে, মুরগি আছে। জৈব সার তৈরির কার্যক্রম আছে। বাঁশ যেহেতু অনেক লাগে, তাই বাঁশ প্রক্রিয়া করার বাবস্থা আছে। পরিবেশ বান্ধব জীবন যাপনের একটা জ্বলন্ত উদাহরণ এই টিডি'র মাটির ঘর। এখন পর্যন্ত এই কুরে ঘরে মাত্র পাঁচ জন থাকতে পারে, আরও কয়েকটা কটেজ তৈরি হচ্ছে, তখন আরও বেশী অতিথি এক সাথে থাকতে পারবে। জঙ্গল আর পাহাড়ের এক দিক দিয়ে নেমে, আরেক দিক দিয়ে উঠে উঠতে, সৌরভ আমাদের তাদের পুরো কার্যক্রম সম্বন্ধে একটা ধারনা দেয়।
এলাকা ভ্রমণ শেষে আমরা আমাদের কুরেঘরে ফেরত এসে তখন গল্প করছি। এমন সময় সৌরভ আবার এলো রুমের ভিতরে বিভিন্ন যায়গায় প্রদীপ আর মোম বাতি জ্বালিয়ে গেল। পুরো ঘরের পরিবেশ তখন একেবারে মায়াবী হয়ে গিয়েছিল। প্রদীপে তেল হিসাবে চা এর একটা বিশেষ তেল ব্যাবহার করেছে। হাল্কা একটা গন্ধ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। লিপা এবং আনিস দুই জনেরই সাইনাস এর সমস্যা আছে, তারা দুই জনই বলল এই তেল জালানোর পর তারা ভালো বোধ করছে।
লিপা চা বানাতে গিয়ে গরম পানি পরে গিয়েছিল পায়ের উপর। আমাদের সাথে ফার্স্ট এইডের অনেক কিছু থাকলেও পোড়া জাতীয় ক্ষত মোকাবেলার কিছু ছিল না। ফোস্কা না পড়লেও বেশ জ্বলছিল। সৌরভ সন্ধ্যার বাতি জ্বালাতে এসে এটা শুনে আবার সেই ২১২ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠে বার্নল আর অ্যালোভেরা নিয়ে এল। বিকালের নাস্তা ছিল মোমো। একটু আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হল যার পাশে বসে আমাদের বেশ আরাম লাগছিল।
রাতে প্রায় আটটার দিকে সৌরভ আবার এল, আমাদের রাতের খাবার নিয়ে। সুন্দর করে হট-পটে প্যাকেট করে, মুরগির গোস্ত, সবজী, ভাত, সালাদ, রুটি এবং ফ্রুট কাস্টারড। টিডি'র পরিবেশ যেরকম আমাদের মুগ্ধ করেছে, খাবারটাও ঠিক তাই। অসম্ভব সুস্বাদু। ঝর্নার অনবরত শব্দ, আর হরেক রকম পোকা মাকড়ের নানা রকমের শব্দ শুনতে শুনতেই আমাদের ভারত ভ্রমণের শেষ রাতটা চলে এসেছে।
রাতে বিছানায় শুয়ে ছাদে পানি পরার টপ টপ শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল, প্রকৃতিরে একেবারে কোলে আমি শুয়ে আছি। প্রায় দেড় মাস ধরে আমি তান এর সাথে যোগাযোগ করেছি, প্ল্যান করেছি, প্রকৃতির মাঝে এই একটা রাতের জন্য।


ঘরে ফেরা
বরাবরি আমার ঘুম ভাঙ্গে খুব সকালে, আর এই ধরনের ভ্রমণেতো কথাই নাই। সকালের হালকা  আলোয় কুড়েঘরের বিভিন্ন দিক থেকে ছবি তুললাম। ভাবছিলাম এখানে আবারো আসতে হবে। সবাই আসতে আসতে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয় নিল। এখানে বাথরুম একটা। টিডি হোম স্টে'র একজন ভলান্টিয়ার আমাদের জন্য চা নিয়ে আসলো, আর রাতের খাবারের জিনিশপত্র নিয়ে গেল। খুব অবাক লাগছিল এরা কিভাবে কতো সহজে ২১২ টা সিড়ি ভেঙ্গে নিচে নামে উপরে উঠে। 
সাড়ে আটটার দিকে আমরা উপড়ে উঠা শুরু করি। গোনার চেষ্টা করি কয়টা সিড়ি। আমি আর লিপা ২০০ সিড়ি গুনলেও উৎস জানালো এখানে ২১২ টা সিড়ি আছে। আমাদের লাগেজ গাড়ির ছাদে বেঁধে আমরা সাড়ে নয়টায় টিডি থেকে চেংরাবান্ধার উদ্দেশ্যে রওনা হই। ফেরার পথে আমরা বিখ্যাত করনেশন ব্রিজ পার হই। 
১৯৩৭ সালে রাণী এলিজাবেথ ও রাজা জর্জ ফোর এর করনেশন উপলক্ষে দার্জিলিং ও জলপাইগুরি জেলার মাঝে তিস্তা নদীর উপর এই ব্রিজ তৈরি হয়। এই ব্রিজের নিচে প্রমত্তা তিস্তা নদী। মাত্র কিছুদিন আগে এই ব্রিজের পশ্চিম পারে টুরিস্টদের সহ একটা  গাড়ি, নদীতে পরে গিয়েছিল। প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে ভূমি ধ্বস হয়েছিল, যার কারণে এই দুর্ঘটনা। গাড়িটার কোন খোজ পাওয়া যায় নাই। 
ব্রিজ পার হয়ে জলপাইগুরি আসার পর দেখি রাস্তার পাশে সারি সারি বানর আমাদের গার্ড অফ অনার দেয়ার অপেক্ষায় আছে। রাস্তার এক পাশে বসে থাকলেও কোন ঝামেলা করে নাই। আমরা যতই চেংড়াবান্ধার দিকে আগাচ্ছি, আসে পাশের দৃশ্য ততোই বদলাচ্ছে। পাহাড়ের বদলে এখন খালি চা বাগান। আমরা চালসা পার হয়ে মালবাজারে এসে থামি দুপুরের খাবারের জন্য।
প্রথম থেকে আমাদের এই ভ্রমণে সব সময় রেডিও ফারুক এফ এম বিনোদন দিয়ে এসেছে। ফারুক যখন ক্লান্ত  হয়ে যেত, তখন বাজতো দিলভার দিলভার গানটা। তবে আমাদের ফেরার পথে সবাই চুপ। সবাই খালি ডানে বামে দেখে, কেউ কারো সাথে কথা বলে না।  
লিপার পেটে  অস্বস্তি থাকায়, ও ছাড়া আমরা বাকিরা দুপুরে খেয়ে নিলাম। সেখান থেকে এক ঘণ্টা পর আমরা চেংরাবান্ধা বর্ডারে। অল্প সময় আমাদের দাপ্তরিক কাজ গুলো শেষ করে, বাপ্পা আর প্রদীপকে বিদায় জানালাম। বুরিমারি এসেই আমাদের কাজ শেষ করে দেখি ইসমাইল ড্রাইভার চলে এসেছে। এবার সেই ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে ফিরে চলা। 
যখন আসরের আজান পড়ছে, তখন আমরা থামলাম চা আর বাথরুমের জন্য। তারপর আবার সবুজ ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে আমাদের সৈয়দপুর ফিরে চলা। এরও বেশ কিছুক্ষণ পর পশ্চিম আকাশে খেয়াল করলাম ঈদের চাঁদ উঠেছে। এই ভ্রমণে আমরা চাঁদের দেখা পাই নাই, একেবারে শেষে আমরা তাও পেয়ে গেলাম। মাগরেব এর আজানের কিচ্ছুক্ষণ পর আমরা সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে পৌছাই। আমাদের যেই রুম দেওয়া হয়েছে, যাওয়ার পথেও আমরা সেই রুমেই ছিলাম - নীলসাগর। 
তৌহিদ আমরা পৌঁছানোর আগেই বলেছিল, সে জিমনেশিয়ামে থাকবে, আমি আর আনিস জেনো চলে যাই ওখানে। দেরি দেখে তৌহিদ নিজেই চলে আসলো আমাদের রুমে। সবাই ফ্রেশ হতে হতে, আমি আর তৌহিদ ওর বাংলোতে ঘুরে আসলাম। এবারো সে আমাদের জন্য বিকালের নাস্তা আর রাতের খাবার বানিয়ে রেখেছে। আমরা রাতের খাবার খেলাম অফিসারস মেসে। কিন্তু সেটা রান্না হয়েছে তৌহিদের বাংলোতে।
রাতে ঠিক হোল, সকালে তৌহিদ সকাল সাতটায় আমদের কিছু একটা দেখাতে নিয়ে যাবে। আমি আর লিপা সকালে উঠে একদম রেডি। তৌহিদ সারে সাতটায় এসে বলে চলো। মাত্র এগারো মাসে সে এই ক্যান্টনমেন্টের অনেক অবকাঠামোগত পরিবিরতন এনেছে। ফেয়ার পার্ক, গলফ কোর্স, অ্যাম্ফি থিয়েটার, লেক, বাগান। প্রতিটা কাজেই রুচির ছাপ স্পষ্ট। তৌহিদের সাথে তাল মিলিয়ে আমি আর লিপা কিছুটা দৌড়িয়ে কিছুটা জোরে হেঁটে ওর কীর্তি গুলো দেখলাম। সকালের এই প্রতভ্রমনের মাঝে তৌহিদ আবার বিভিন্ন সৈনিকদের সাথে কথাও বলছিল। ওদের সম্পর্কটা আমার কাছে খুব ভাল লেগছে। 
রুমে এসেই আমাদের লাগেজ পাঠিয়ে দেয়া হোল এয়ারপোর্টে। আমরা নাস্তা খেয়ে তৌহিদের সাথে এই যাত্রায় শেষ বারের মতো ছবি তুলে রওনা হলাম সৈয়দপুর এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। প্লেনে উঠার আগে শেষ একটা গ্রুপ সেলফি তুলে আমার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। স্বপ্নের মত কয়েকটা দিন কাটিয়ে ফিরে এলাম কংক্রিটের জঙ্গলে। 

প্লেনে উঠে আনিসকে জিজ্ঞেস করলাম, দোস্ত মনে আছে একেবারে শুরুতে ট্রেন পাঁচ ঘণ্টা লেইট ছিল?  

- crocodilefarmer@gmail.com