২০০৪ সালে মাত্র ৭৪ টি কুমির নিয়ে রেপ্টাইলস ফার্ম লিমিটেডের হাত ধরে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক কুমির চাষের যাত্রা শুরু হয়েছিল। অনেক দ্বিধা অনেক সংশয় ছিল সে সময়। ২০০৬ সালে প্রথমবার দুইটি কুমির ৬৯টি ডিম পারে, তিনটা বাচ্চা ফুটে কিন্তু একটি বাচ্চাও ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বাঁচে নাই। এর পরের বছর ৬০০ ডিম থেকে ১৪১ টি কুমির ছানা পাওয়া যায়। বর্তমানে খামারে প্রায় ৩০০০ বিভিন্ন বয়সের কুমির আছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে দ্বিতীয় কুমিরের খামার - আকিজ ওয়াইল্ড লাইফ লিমিটেড যাত্রা শুরু করে ৫০ টি কুমির নিয়ে, এখন সেখানে আছে প্রায় ২০০০ কুমির। ২০১০ সালে ৬৭টি কুমির (হিমায়িত অবস্থায়) জার্মানিতে রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ কুমির রপ্তানি শুরু হয়।
কুমির চাষ করা হয় মূলত কুমিরের চামড়ার জন্য, তা ছাড়া কুমিরের মাংসের একটা বিরাট বাজার আছে। অস্ট্রেলিয়ার শুধু মাত্র নর্দার্ন টেরিটরিতে ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে কুমির চাষ করে আয় করেছে ২৯.৩ মিলিওন ডলার। সেখানে মাত্র আটটি খামার থেকে এই পরিমাণ আয় হয়েছে। রেপ্টাইলস ফার্ম ২০১৪ সালে ৪৩০টি, ২০১৫ সালে ৪০০টি, ২০১৬ সালে ২০০টি এবং এই বছর ২০১৯ সালে ২২৬টি চামড়া রপ্তানি করেছে জাপানে। কুমিরের ২৪ টি প্রজাতির মধ্যে লোনা পানির কুমিরের (Crocodilus porosus) চামড়ার মূল্য সবচেয়ে বেশী। বিশ্ব বাজারে ২০০৩ সালে যেখানে ২৬,৫৬৪টি লোনা পানির কুমিরের চামড়া বিক্রি হয়েছে, সেখানে বারো বছরের বাবধানে ২০১৫ সালে ৭১,১৪২টি চামড়া বিক্রি হয়েছে। ৭১,১৪২ এর মধ্যে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ৪০০। ৭১,১৪২ এর সিংহভাগ রপ্তানি করেছে অস্ট্রেলিয়া ও পাপুয়া নিউ গিনি- যথাক্রমে ৩৪,৮৭৮ ও ১২,৫৩২টি।
সাধারণ চামড়া দিয়ে যে সকল পণ্য তৈরি হয়, কুমিরের চামড়া দিয়েও একই পণ্য তৈরি করা সম্ভব। কাচা মাল হিসাবে কুমিরের চামড়ার মূল্য বেশী হওয়ায়, কুমিরের চামড়া দিয়ে তৈরি পণ্যের মূল্য অনেক বেশী হয়ে থাকে। সাধারণত কুমিরের পেটের চামড়া সবচেয়ে মূল্যবান, একটি লোনা পানির কুমিরের উন্নতমানের কাচা চামড়ার মূল্য ১০০০ ডলার হতে পারে। কুমিরের মাংস ও অন্যান্য উপকরণ বিক্রির মাধ্যমে আরও ২০০ ডলার আয় করা সম্ভব। ধারনা পাওয়ার জন্য এখানে উল্লেখ্য ইন্টারনেটে লোনা পানির কুমিরের চামড়ার তৈরি আই ফোনের কভার বিক্রি হয় ৭০০ থেকে ৮০০ ডলার মূল্যে।
লোনা পানির কুমিরের পেটের চামড়া একেবারে মোলায়েম, তবে বয়স পাঁচের বেশী হলেই চামড়ার নীচে মাছের আঁশের মতো একটি পদার্থ জমাট বাঁধে, এতে করে চামড়া শক্ত হয়ে যায়। বাণিজ্যিক কাজে চামড়া আহরণের ক্ষেত্রে তা পাঁচ বছর বয়সের আগেই করা হয়। তিন বছর বয়সের একটি কুমিরের থেকে গড়ে এক বর্গ ফুট চামড়া আহরণ করা সম্ভব। কুমিরের উপরের দিকে ঘাড় থেকে শুরু করে লেজ পর্যন্ত লম্বা করে কাটা চামড়া দিয়ে তৈরি হয় মূল্যবান বেল্ট। পা গুলো দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন সুভেনির। ২০১৩-২০০১৪ সালে পাপুয়া নিউ গিনি, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ৭০,০০০ কুমিরের দাঁত রপ্তানি করেছে। কুমিরের দাঁত দিয়ে তৈরি হয় অলঙ্কার। একই সময় অস্ট্রেলিয়া থেকে কুমিরের মাংস রপ্তানি হয়েছে ৫৭ টন। পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলোই মূলত কুমিরের মাংসের আমদানি কারক। উন্নতমানের কুমিরের চামড়ার মুল বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা।
কুমিরের চামড়া উৎপাদনের ক্ষেত্রে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। ইউরোপের নাম করা ক্রেতারা সামান্য দাগ বা আঁচড় থাকলেও তাকে বাতিল করে দেয়, যার মূল্য তখন ৩০-৪০ শতাংশ কম হতে পারে। লেদার ইঞ্জিনিয়ারস এন্ড টেকনোলজিস্ট'স সোসাইটি, বাংলাদেশ এর ভাইস প্রেসডেন্ট মঃ আফজাল হোসেন বলেছেন বাংলাদেশে কুমিরের চামড়া প্রক্রিয়া করার সমস্ত প্রযুক্তি আছে। সমন্বয় এবং নীতিমালা সংশোধনের মাধ্যমে নতুন একটি শিল্প খাত গড়ে উঠতে পারে। আমাদের বাংলাদেশের চামড়া শিল্প অনেক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, এর সাথে কুমিরের চামড়া জাত পণ্য নতুন সংযজন হতে পারে।
বাংলাদেশে কুমির চাষের বাণিজ্যিক সম্ভবনা নিয়ে প্রথম গবেষণা করেছিলেন রমুলাস হুইটেকার সেই ৮০র দশকে। রমুলাস হুইটেকার ভারতে অবস্থিত মাদ্রাস ক্রকডাইল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং বন্য প্রাণীর প্রতি তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ গতবছর পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। লেখকের সাথে ২০০৩ সালে কুমির চাষ নিয়ে আলাপের সময় তিনি জিজ্ঞেস করেন ব্রিডিং ষ্টক কোথা থেকে সংগ্রহ করা হবে। লেখকের তখনো যানা ছিলোনা আন্তর্জাতিক আইন কানুন। কুমিরের খামার শুরু করতে প্রাপ্ত বয়স্ক কুমিরের প্রয়োজন- যাকে ব্রিডিং ষ্টক বলে। কুমির সাধারণত ৮-১০ বছর বয়স থেকেই ডিম পারা শুরু করে। লেখক উত্তর দিয়েছিল অন্য কোন কুমিরের খামার থেকে ব্রিডিং ষ্টক সংগ্রহ করা হবে। তখন মালয়েশিয়া থেকে আনা ৭৪ টি কুমির দিয়ে বাংলাদেশে কুমিরে চাষের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে রেপ্টাইলস ফার্ম লিমিটেড ও আকিজ অওাইল্ড লাইফ লিমিটেড এর যেই কুমিরের সংগ্রহ আছে তা দিয়েই আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১০ হাজার চামড়া উৎপাদন সম্ভব। আভ্যন্তরীণ জটিলতার কারণে রেপ্টাইলস ফার্ম লিমিটেডের চামড়া রাপ্তানি প্রক্রিয়া শুরু হয় কয়েক বছর পরে। এতে করে রপ্তানি উপযোগী কুমিরের বয়স বেরে যাওয়ায় তা এখন ব্রিডিং স্টকে রূপান্তরিত হয়েছে। নিজস্ব চাহিদার থেকে বেশী ব্রিডিং স্টক থাকায় বাংলদেশে কোন উদ্যোক্তা এখন নতুন খামার শুরু করতে হলে, বিদেশ থেকে ব্রিডিং স্টক আমদানির প্রয়োজন পরবে না।
২০০৩/২০০৪ বাংলাদেশে কুমির চাষের প্রথম প্রতিবন্ধকতাই ছিল ব্রিডিং স্টকের জোগান, আজকে ১৫ বছর পড় বাংলাদেশ ব্রিডিং স্টকের ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণ। বাণিজ্যিক খামারে উৎপাদিত F2 জেনারেশনের লোনা পানির কুমিরেরে ব্রিডিং স্টক দিয়ে বেশ কয়েকটি খামার শুরু করা সম্ভব।
আমদানিকৃত ব্রিডিং স্টক এর ক্ষেত্রে স্থানীয় আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে দুই বছরের বেশী সময় লাগতে পারে, দেশের কোন খামার থেকে ব্রিডিং স্টক সংগ্রহ করলে এই সময়টা অনেক কম লাগবে। রেপ্টাইলস ফার্ম লিমিটেডের শুরুতে ২০০৪ সালে দুই জন কর্মকর্তাকে ভারতে পাঠানো হয়েছিল কুমিরের উপর ধারনা নেওয়ার জন্য। এখন আমাদের দেশেই প্রায় ৬০-৭৫ জন কর্মচারী পাওয়া যাবে যাদের কুমির লালন পালনের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। তাছাড়া কুমির লালন পালন এবং প্রজননের জন্য যেই কারিগড়ি দক্ষতা দরকার, তা সামান্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই রপ্ত করা সম্ভব।
শুধু মাত্র কাচা চামড়া রপ্তানি মাথায় না রেখে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে চামড়া জাত পণ্য তৈরি করে- তৈরি পণ্য রপ্তানির দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। কুমির একটি নবায়ন যোগ্য সম্পদ, প্রতি বছর গড়ে ৩০টি ডিম দেয়, প্রায় ২৫০০ ডিম পারে তার আয়ুষ্কালে। বাংলাদেশের আবহাওয়া লোনা পানির কুমির প্রজনন ও লালন পালনের জন্য অনুকূল। বন বিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে এবং আন্তর্জাতিক বিধি বিধান মেনে ক্ষুদ্র আকারে কুমিরের বাণিজ্যিক খামার গড়ে তোলা সম্ভব।
কুমিরের বাণিজ্যিক খামার পৃথিবীর যেই সকল অঞ্চলে আছে, সেখানে কুমিরের চামড়া থেকে যা আয় হয়, তার প্রায় সম পরিমাণ আয় হয় কুমির কেন্দ্রিক পর্যটন থেকে। এর জন্য প্রয়োজন হয় আলাদা অবকাঠামো- যা বাংলাদেশে নাই। আন্তর্জাতিক বিধিমালার কারণে অস্ট্রেলিয়াতে যেভাবে কুমিরের চাষ হয়, আমাদের দেশে সে ভাবে হয় না। অস্ট্রেলিয়াতে প্রকৃতিতে লোনা পানির কুমিরের সংখ্যা যখন ৫০০০ এর নীচে নেমে আসে, তখন ১৯৭১ সালে কুমির শিকার সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে সেখানে প্রকৃতিতে লোনা পানির কুমিরের সংখ্যা ১০০,০০০। অস্ট্রেলিয়াতে কুমির চাষিরা প্রকৃতি থেকে ডিম সংগ্রহ করে, নিজেদের খামারে বাকি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। প্রতিটি ডিমের জন্য ভূমি মালিক ও স্থানীয় সরকারকে কর দিতে হয় চাষিদের। অস্ট্রেলিয়ায় ডিমের সরবারহ অনেক বেশী হলেও, একটি ডিমের সংগ্রহ মূল্য প্রায় ১০০ ডলার পরে যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশে খামারে ব্রিডিং স্টক রেখে ডিম উৎপাদন করলে উৎপাদন খরচ তুলনামূলক ভাবে কম হয়।
আমাদের দেশে দীর্ঘ মেয়াদি কুমির সংরক্ষণের পরিকল্পনা করলে সুন্দরবনে কুমিরের সংখ্যা ২০০ থেকে বৃদ্ধি করে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব যখন খামারিরা বন বিভাগের কাছ থেকে ডিম সংগ্রহ করতে পারবে। এর জন্য প্রথমত সুন্দরবনে কুমিরের সংখ্যা বারাতে হবে, দ্বিতীয়ত সি আই টি ই এস (CITES) এর অ্যাপেন্ডিক্স এর সংশোধন করতে হবে। বাংলাদেশের যেহেতু এখন নিজস্ব ব্রিডিং ষ্টকের সরবারহ আছে, তাই বাণিজ্য মন্ত্রানালয় এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উচিৎ কুমির চাষ ও কুমির জাত পণ্য উৎপাদনের একটি যুগপযুগি নীতিমালা প্রণয়ন।
মুশতাক আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত কুমির চাষি ও লেখক
crocodilefarmer@gmail.com
Reference: